সমুদ্রের নোনা জলের ঝাপটায় অপরূপ সৌন্দর্য্য নিয়ে জেগে রয়েছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। বিকাশের ধারায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই পর্যটন কেন্দ্র।
অনেক সম্ভাবনা, অনেক স্বপ্ন। এখানকার সৈকতের দীর্ঘ বেলাভূমিতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আকর্ষণ দেশজোড়া। দলে দলে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এ বেলাভূমিতে। তবুও কোথায় যেন থেকে যায় একের পর এক সঙ্কট। জটিলতার অবসান হয় না কিছুতেই। সঙ্কটের ভেতর দিয়েই ডানা মেলছে কুয়াকাটা। তারপরও প্রতিটি নতুন ভোরে নতুন আশাবাদ। এই বুঝি কুয়াকাটা ফিরে পেল প্রাণ। এইসব নিয়ে কুয়াকাটা উপাখ্যান শিরোনামে বাংলানিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে এসে: ঢেউয়ের ঝাপটায় ভাঙছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ভাঙন রোধে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ। তবুও রোধ হচ্ছে না। বর্ষায় প্রবল স্রোতে আর অতিরিক্ত জোয়ারের পানি লণ্ডভণ্ড করছে সৈকতের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। এসব কারণে কুয়াকাটার আকর্ষণ কমছে বলে মনে করেন অনেকেই। পর্যটকেরা হতাশায়, চিন্তার ভাঁজ বিনিয়োগকারীদের কপালে।
তবে সমাধান রয়েছে বিশেষজ্ঞদের কাছে। তারা বলছেন, বর্ষায় সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝাপটা ও প্রবল স্রোতে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় গ্রোয়েন বাঁধই যুগপোযোগী ব্যবস্থা হতে পারে। মৌসুমী বালুক্ষয় রোধ ও ভাঙনের কবল থেকে কুয়াকাটা সৈকতকে বাঁচাতে এ বাঁধ সমুদ্রের স্রোতধারা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। সেই সঙ্গে সৈকতে পলি জমে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি তৈরিতে সহায়ক হবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুয়াকাটা সৈকতের বিভিন্ন অংশে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সৈকতের পশ্চিম দিকে ভাঙন চলে এসেছে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত। ব্লক ফেলেও সে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্রের জিরো পয়েন্টেও ভাঙন রয়েছে। জিরো পয়েন্টের ‘ঘাটলা’ বলে পরিচিত জায়গাটি এখন আর অবশিষ্ট নেই।
সমুদ্রের ঢেউ এসে ধাক্কা দেয় বাঁধের কিনারে। অন্যদিকে, প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় সৈকতের প্রশস্থতা কমে এসেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও টুরিস্ট সেন্টারের পরিচালক রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ভাঙনের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে গেছে। পাঁচ থেকে ১০ বছর আগের চেহারার সঙ্গে বর্তমান কুয়াকাটার কোনো মিল নেই। সৈকতের গা ঘেঁষে ঘর-বনরাজি এখন আর নেই। সৈকতের প্রশস্থতা কমে এখন কুয়াকাটা যেন একেবারেই অচেনা। এর ওপর পরিকল্পনাহীনভাবে ডানা মেলছে এ পর্যটন কেন্দ্র। ভাঙন রোধ কিংবা সৌন্দর্য্য বর্ধনে বিশেষ কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না। ফলে কুয়াকাটার সম্ভাবনা বিকাশ নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখেন, তারা হতাশ।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা প্রকল্প ১০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও এখানকার ঐতিহাসিক ও আধুনিকভাবে গড়ে ওঠা মূল্যবান স্থাপনা পর্যটকদের আকৃষ্টকারী স্পটগুলো সমুদ্রের ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে আন্ধারমানিক ও পূর্বদিকে রয়েছে রামনাবাদ মোহনা। দুই মোহনার মধ্যে ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে আন্ধারমানিক মোহনার একাধিক পয়েন্টে। কয়েক বছর ধরে এর ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারণ করায় হুমকির মুখে পড়ে দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকত ও বেড়িবাঁধ। বিনিয়োগকারীদের মোটা অংকের বিনিয়োগ ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকিতে। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জোন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কুয়াকাটা সৈকতের মাঝিবাড়ি পয়েন্ট, লেম্বুরচর, কম্পিউটার সেন্টার, ইসলামপুর দাখিল মাদরাসা, বিপিনপুর, মনোহরপুর, পুরান মহিপুর, হাজীপুর, খ্রিস্টান পল্লীর সদরপুর ও লালুয়ার চারিপাড়া এলাকা। এসব জায়গায় নতুন করে স্থাপনা তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা।
একমাত্র গ্রোয়েন বাঁধই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত স্থায়ীভাবে রক্ষা করতে পারে বলে মত দেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন প্রফেসর আ ক ম মোস্তফা জামান।
তিনি মনে করেন, এটি এক ধরনের স্পেশাল টার্ম। গ্রোয়েন বাঁধ সমুদ্রের স্রোতধারা পরিবর্তন করে দিতে পারে। এর ফলে সৈকতে বালু ক্ষয় রোধ, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও সবুজ বেস্টনি রক্ষা করে বিস্তীর্ণ বেলাভূমি তৈরিতে সহায়তা করবে।
কুয়াকাটার ভাঙনের সূত্র তুলে ধরে প্রফেসর আ ক ম মোস্তফা জামান বলেন, আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ মোহনার মূল স্রোত এসে কুয়াকাটার বেলাভূমিতে আঘাত হানে। এরফলে সৈকতে বালু ক্ষয় ও বেড়িবাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হয়। জোঁ’র সময় জোয়ার ও ভাটায় স্রোতে এ বালু ক্ষয় হয়। গ্রোয়েন বাঁধে স্রোতধারা পরিবর্তন করতে সহয়তা করে। পানি বাধাগ্রস্ত হয়ে সৈকতে পলি জমে বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে পরিণত হবে সৈকত। গ্রোয়েন বাঁধ হলে প্রতিবছর কুয়াকাটা রক্ষা বাঁধে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে না। পর্যটকদের কাছে কুয়াকাটার আকর্ষণ আরও বাড়বে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেইভ দ্য কোস্টাল পিপলস (স্কোপ) এর নির্বাহী পরিচালক এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের নিকটে ভৌগলিক কারণে বঙ্গোপসাগর ও আন্ধারমানিক নদীর মোহনা মিলিত হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষায় ভাঙনের তীব্রতা দেখা দেয়। এটি রোধে আন্ধারমানিক নদী শাসন ও সমুদ্রের স্রোতধারা পরিবর্তন করা হলেই কুয়াকাটা সৈকত রক্ষা পেতে পারে। সেটি কেবল গ্রোয়েন বাঁধ দিয়েই সম্ভব।
কুয়াকাটা রক্ষায় গ্রোয়েন বাঁধের দাবি তোলেন স্থানীয় সমাজ উন্নয়ন কর্মী ও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) লতাচাপলী ইউনিয়ন টিম লিডার মো. শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, আন্ধারমানিক মোহনার মূল স্রোত এসে কুয়াকাটার বেলাভূমিতে আঘাত হানায় সৈকতে বালু ক্ষয় ও বেড়িবাঁধ ভাঙনের সৃষ্টি হয়। আন্ধার মানিক মোহনার জিরো লেভেল পানি থেকে তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার লেম্বুর চর এলাকায় পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার উচ্চতার গ্রোয়েন বাঁধ এখন সময়ের দাবি।
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, কুয়াকাটা সৈকত দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙছে। ফি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
কুয়াকাটা ইনভেস্টর্স ফোরামের মুখপাত্র ও রোটারি ক্লাব অব কুয়াকাটা বিচের সেক্রেটারি হাসনুল ইকবাল বলেন, এরই মধ্যে সৈকতের লাগোয়া এলজিইডির বাংলো কাম বায়ো গ্যাসপ্লান্ট বিধ্বস্ত হয়েছে। সৈকতের বালু ক্ষয় রোধে ও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষায় অপরিকল্পিতভাবে ব্লক দিয়েও প্রতিরোধ হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলেছে, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প প্রতিবেদন প্রস্তাবনায় নয় কোটি ৯৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা চেয়ে, বাংলাদেশ পানিউন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণ অঞ্চল জোন বরিশালের খেপুপাড়া পাউবো উপ-বিভাগীয় কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। ওই প্রস্তবনায় সৈকতের বেলাভূমের ক্ষয়রোধ ঠেকাতে সিসি ব্লক দেয়ার কথা ছিল। সে প্রকল্পটি আজও অনুমোদন হয়নি। গত কয়েক বছরে তিন কিলোমিটার সৈকত ও ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সমুদ্রে বিলীন হয়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষা সূত্রে জানা গেছে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় পাউবোর মাধ্যমে ৫২ কোটি টাকার একটি নতুন প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে। তবে গ্রোয়েন বাঁধের মতো এমন বৃহৎ কোনো প্রকল্প করা যায় কিনা, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
কুয়াকাটা রক্ষা প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকার বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এখানকার সব উন্নয়ন করা হবে। ভাঙন রোধে গ্রোয়েন বাঁধ প্রযোজ্য কিনা, সে বিষয়টির জন্য সমীক্ষা করে দেখতে হবে।
[পশ্চিমে সাতক্ষীরা, পূর্বে টেকনাফ, উপকূলের এই ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা বেষ্টিত অঞ্চলে সরেজমিন ঘুরে পিছিয়ে থাকা জনপদের খবরাখবর তুলে আনছে বাংলানিউজ। প্রকাশিত হচ্ছে ‘উপকূল থেকে উপকূল’ নামের বিশেষ বিভাগে। আপনি উপকূলের কোন খবর বাংলানিউজে দেখতে চাইলে মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]]
বাংলাদেশ সময়: ০১৪২ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫
আরআইএম/এসএস
** জাতীয় উদ্যান নামেই দাঁড়িয়ে আছে!
**মহাপরিকল্পনা ফাইল চাপা, সংকট সীমাহীন
** সৈকত সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই
উপকূল থেকে উপকূল
কুয়াকাটা উপাখ্যান (শেষ)
গ্রোয়েন বাঁধই রক্ষা করতে পারে সৈকত
রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।