ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন-২

দস্যুদের কার্ডেও নেই জীবনের নিশ্চয়তা

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৫
দস্যুদের কার্ডেও নেই জীবনের নিশ্চয়তা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার তাই অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে জলদস্যু উৎপাত। তারওপর রযেছে দাদনের নীপিড়ন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাতো বেড়েই চলেছে। তাদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদার এর আট পর্বের প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে: ইলিশের মৌসুমে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবন এলাকায় সক্রিয় থাকে কমপক্ষে ২০ দস্যু বাহিনী। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জেলেরা। তবুও শান্তিতে মৎস্য আহরণের আশায় দস্যুদের কাছ থেকে চড়া দামে ‘পাসকার্ড’ সংগ্রহ করে সাগরে নামেন জেলেরা।

কিন্তু এই পাসকার্ড নিয়েও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। এক বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করলে অন্য বাহিনীর অত্যাচার বেড়ে যায় দ্বিগুণ। আবার যে বাহিনীর কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহ করা হয় তারাই বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চালায় নির্যাতন, জেলেদের আটকে রেখে আদায় করে মুক্তিপণ। চড়া দামের বিনিময়ে সংগ্রহ করা পাসকার্ডও তখন হয়ে যায় ভিত্তিহীন!

জেলে সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) হাতে দস্যু বাহিনী প্রধান মারা গেলেও সেই দলের সদস্য ও নতুন বাহিনী আবারও সংগঠিত হয়ে দস্যুতা চালায়।

সাগরে রাজু, গামা, নাসির, নূর হাবিব, শহিদ, সোবাহান, নানা মহুবর, বড় ভাই, মাইজ্যা ভাই, কবির, বাদল, মুকুল, সাকাত, আনোয়ার, বেলাল, সজল, জালাল, মাহাতাব, সিদ্দিক, জিহাদ, শিষ্য ও বাদল বাহিনী নামে সক্রিয় রয়েছে। এরাই মূলত পাসকার্ড বাণিজ্য পরিচালনা করে। আর এ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে সাগর থেকে নগর পর্যন্ত সব স্তরের মানুষ। দস্যু বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্থানীয় কিছু জেলে ও প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি মহল পরিচালনা করে এই বাণিজ্য। আর এ বাণিজ্যের বলির পাঠা হয় উপকূলের নীরিহ জেলেরা।

সাগরে মাছ ধরতে আসা জেলেদের প্রতি ইলিশ মৌসুমের শুরুতে দস্যুদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পাসকার্ড সংগ্রহ করতে হয়। যদি কোনো জেলে এ কার্ড না করে সাগরে মাছ ধরতে যান তাহলে তাকে প্রাণ হারাতে হয়, অন্যথায় মুক্তিপণ দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। আবার পাসকার্ড সংগ্রহ করলেও বিড়ম্বনার শেষ নেই।

সূত্র জানায়, প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে মহাজনের কাছে বিভিন্ন দস্যু বাহিনী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সাগরে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে কার্ড করার পরামর্শ দেয়। কার্ড প্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে দিয়ে কার্ড সংগ্রহ করতে হয় মহাজনদের। যার মেয়াদ দেওয়া হয় এক বছর। বছর শেষে আবার কার্ড সংগ্রহ করতে হয়।

প্রথমে দস্যুরা সাগরে বিভিন্ন ট্রলারের জেলেদের আটক করে তাদের মালিককে ফোন দিয়ে পাসকার্ড করতে বলে। পরে দস্যুদের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দিলে তারা জেলেদের পাসকার্ড দিয়ে ছেড়ে দেয়। আবার কিছু দস্যু বাহিনী মহাজনদের গতিবিধির উপর নজর রেখে ফোন করে পাসকার্ড সংগ্রহ করতে বলে। এসময় দস্যুদের চাওয়া টাকা বিকাশ করলে তারা পাঁচ অথবা পঞ্চাশ টাকার নতুন একটি নোটের সিরিয়াল নম্বর পাসকার্ড নম্বর হিসেব ব্যবহার করতে বলে।

বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী দস্যুদের কাছ থেকে পাসকার্ড সংগ্রহের কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা জেলেদের নিরাপত্তা দিতে না পারায় তারা বাধ্য হয়ে পাসকার্ড সংগ্রহ করে। তবে কেউই পাসকার্ড সংগ্রহের কথা বলতে চায় না।

জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি বাংলানিউজকে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাই তারা প্রাণ রক্ষায় দস্যুদের টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু তা নিয়েও শান্তিতে নেই জেলেরা। তাই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলেদের নিরাপত্তার দাবি করেন এই জেলে নেতা।

তিনি আরও জানান, পাসকার্ড সংগ্রহের পরও জেলেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এক দস্যু বাহিনীর কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করলেও আরেক দস্যু বাহিনী হামলা ও লুটপাট চালায়। অনেক সময় দস্যুরা দল ও উপদলে ভাগ হয়ে জেলেদের ওপর অত্যাচার চালায়।

পাথরঘাটা কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. এফ এ রউফ বাংলানিউজকে বলেন, এবিষয়ে আমাদের কাছে জেলেরা কোনো অভিযোগ করতে চায় না। তবে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু জীবনের ভয়ে অনেক জেলে এ পাসকার্ড সংগ্রহ করেন বলে তিনি স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বাংলানিউজকে বলেন, দস্যুরা জেলে পল্লীতে ছদ্মবেশে ঢুকে পাসকার্ড বিতরণ করে বলে আমরা শুনেছি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা অভিযান চালাব।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৫
এসএইচ/জেডএম

** দস্যু ভয় তবু যেতে হয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।