ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের জেলে জীবন-৪

ঋণ-দাদনে দিশেহারা জীবন

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৫
ঋণ-দাদনে দিশেহারা জীবন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরসহ উপকূলীয় জেলেদের জীবিকা চলে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকার করে। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব জেলের দুর্দশার তাই অন্ত নেই।

একদিকে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই, আরেক দিকে দস্যুদের উৎপাত। তারওপর রযেছে দাদনের নীপিড়ন। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝাতো বেড়েই চলেছে। তাদের অন্তহীন দুর্দশার চিত্র নিয়ে বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদার এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।

উপকূলের জেলে পল্লী ঘুরে: ঋণ ও দাদন নামের অভিশাপে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছেন উপকূলের জেলেরা। কখনো নদীতে থাকে না মাছ, আবার কখনো থাকে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাগর কিংবা নদীতে তেমন একটা ইলিশ পাওয়া যায় না। আবার মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ইলিশ মিললে উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে ইলিশ শিকার থাকে বন্ধ।

প্রতি বছর এই সময়গুলোতে জেলে পল্লীতে নেমে আসে দুর্দিন। এ সুযোগটি কাজে লাগায় কিছু অসাধু দাদন ব্যবসায়ী ও অতি মুনাফালোভী মহাজন।

ছেলে সন্তান নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এসময় চড়া সুদে এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নেন জেলেরা। সংসারে সবার মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে নিরুপায় জেলেরা এ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করেন ইলিশ মৌসুমের।

উপকূলের মৎস্য সম্পদ আহরণে নিয়োজিত মানুষগুলোর হাড্ডিসার দেহ দেখে বিশ্বাস হবে না এরাই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নীরবে। আর হিসাবের বেলায় এরাই থেকে যাচ্ছেন সবচেয়ে নিগৃহীত। ঝড়ঝঞ্ঝা, প্রচণ্ড শীত ও গরমকে উপেক্ষা করে জীবনবাজি রেখে গভীর সমুদ্রে ছুটে যান। তাদের এ শ্রমের ফলে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন আড়ৎদার, দাদনদার আর মহাজনরা।

জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলে পরিবারগুলো। অনেকের ৮/১০ বছরের শিশুপুত্র দিনরাত উপেক্ষা করে বাঁচা-মরা লড়াইয়ে সামিল হয়। জালের ফাঁকে ইলিশ আটকালেও ভাগ্যের ফাঁক দিয়ে সেই ইলিশ চলে যায় মহাজনের মোকামে।

ইলিশ ভর্তি জেলে নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজ পাখির মত ছোঁ মারে মহাজনের লোকেরা। দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের শক্তি নেই জেলেদের। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের। মাছের সঠিক দাম তো দূরের কথা, দাদনের হিসাব চেয়ে কোনো জেলে প্রতিবাদ করলে মহাজনরা শহরের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে এসে অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহারের অভিযোগে জেলেদের শেষ সম্বল জালটাও পুড়িয়ে দেয়। জেলেদের হাত-পা বাঁধা দাদনের জালে।

অন্যদিকে রয়েছে এনজিও ও অতি মুনাফালোভীদের ঋণ ব্যবস্থা। ইলিশ মৌসুমে সুদে-আসলে এ ঋণ পরিশোধ না করলে নৌকার দাড় টানার বদলে টানতে হয় জেলের ঘানি। অনেক জেলে মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিও’র চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে।

বরগুনার ঢলুয়া ইউনিয়নের জেলে বেলায়েত একসময় সমুদ্রে মাছ ধরতেন,  এখন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে একটি মুদি দোকন দিয়ে বসেছেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে মাছ ধরি, ডাহাইতে পিডাইছে, বইন্নায় সব গেছে, হেরপরও মাহাজনের চাপ কমেনি, টাকা কড়ায় গণ্ডায় পরিশোধ করা লাগছে। বাপের ভিটেমাটি বেইচ্চা ঋণ পরিশোধ করতে হইছে, এহন আর কিছুই নাই।

বরগুনার ঢলুয়া ইউনিয়নের জেলে আক্কাস বাংলানিউজকে বলেন, কাজ করি মোরা, মধু খায় হেরা। সব জানি কিন্তু কিছুই কওয়ার নাই মোগো হাত-পাও যে বান্ধা হেগো কাছে। ’

উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা ও জেলে নিয়ে কাজ করছে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন অব কোস্টাল এরিয়াস পিপল‘স  (ডোক্যাপ)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মাসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে মৎস্য সম্পদ। আর এই মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জেলেদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না কখনোই। ঋণ আর দাদনের নিষ্পেশনে প্রতিনিয়ত ধুঁকছেন তারা। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত এবিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

এ বিষয়ে বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান ঝন্টু বাংলানিউজকে বলেন, মৎস্য শিল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। আর এই অর্জনের বড় অংশটাই আসছে সমুদ্রে আহোরিত মাছ থেকে। অর্জনের পেছনে নিরন্তর কাজ করছেন জেলেরা। কিন্তু হিসাবের বেলায় জেলেরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই শুধু সমুদ্রে মৎস্য শিকারে যাওয়া জেলেদের জন্য বাজেটেই আলাদা করে বরাদ্দ রাখার দাবি করছি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে।

তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে সরকারের উচিত জেলেদের বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বঙ্কিম চন্দ্র বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, জেলেরা প্রতিনিয়ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন, কিন্তু জেলেদের জন্য এখন পর্যন্ত সুদ মুক্ত কোনো ঋণের ব্যবস্থা নেই। কোনো ব্যাংক ইচ্ছে করলে তাদের সুদ মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। তবে সেটা মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৫
এসএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।