ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূলের শিশু-৩

শুটকি চরের শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা

সুমন সিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
শুটকি চরের শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[কখনো জেলে, কখনো কৃষক, কখনোবা কঠোর পরিশ্রমী দিনমজুর। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত জীবন।

শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়তি যাদের নিয়ে যায় হাড়ভাঙা কর্মে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে কন্যা শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্যসঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার এই চিত্র তুলে এনেছে বাংলানিউজ। বরগুনা করেসপন্ডেন্ট সুমন সিকদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব। [

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছে উপকূলের বিভিন্ন চরে শুটকির কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকরা। শুটকি পল্লীগুলোতে কর্মসংস্থান হয় হাজারো মানুষের। এখানে কর্মরত জনসংখ্যার অধিকাংশই শিশু। যাদের থাকার কথা পড়ার টেবিলে। অথচ তারা এখানে ব্যস্ত থাকে শুটকি আহরণ ও শুকানোর কাজে। বছরের অর্ধেকটা সময় ধরে সচল থাকে উপকূলের শুটকি পল্লীগুলো। অনেক শিশু স্কুলে না গিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে এখানে আসে কাজে সহযোগিতা করতে।

আবার কেউ কেউ আসে জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার তাগিদে। যে যেভাবেই আসুক না কেন যেসব শিশু এখানে কাজ করে একসময় তাদের আর স্কুলে যাওয়া হয় না। শিক্ষার চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই থেমে যায়।

কথা বলার কিংবা শোনার ফুসরত নেই কারো। নৌকাগুলো নোঙর করতেই কুঁড়েঘর থেকে লাঠি নিয়ে দৌড়ে সেদিকে যায় শিশুরা। নৌকা থেকে ঝাঁপিভর্তি ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নামছে চরের হাঁটু জলে। আর তাদের হাতের সেই কাঠির রশিতে ঝাঁপি লাগিয়ে দুই প্রান্তে দু’জন বয়ে চলে তীর ধরে। মাছগুলো চাটাইয়ের ওপর বিছিয়ে রোদে শুকানো হবে। কিন্তু এর আগে আবর্জনা ও বাছাই। এই কাজটি করে একদল নারী ও শিশু। চাটাইয়ে ঢালতেই নারী ও শিশুরা লেগে পড়ে বাছাইয়ের কাজে। এরপর রোদে শুকানো।

দৃশ্যটি বরগুনার তালতলী উপজেলার আশার চর শুটকিপল্লীর। জেলার আশার ও লালদিয়ারচর এলাকায় দুটি চরে বছরের ৬ মাস ধরে চলে শুটকি আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ। শুটকিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে এ দুই চর।

অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, মংলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জেলেরা নৌকাসহ সপরিবারে এ চরে এসে কুঁড়েঘর তৈরি করে অবস্থান নেয়। এই চরেই গড়ে তোলে তাদের মৌসুমী সংসার।  

এরকমই এক মৌসুমী সংসারের বাসিন্দা তালতলী উপজেলার আশার চরের জীবন(১২)। যার যাওয়ার কথা ছিলো বিদ্যালয়ে। কিন্তু সে এখন জীবিকার তাগিদে কাজ করছে শুটকি পল্লীতে।

জীবন বাংলানিউজকে বলে, আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য এ কাজ করতে হচ্ছে। লেখাপড়া বন্ধ। একসময় ভালোই ছিলাম, বাপের ট্রলার ছিলো। গাঙে মাছ ধরতো। ভালোই চলছিলো আমাদের সংসার। হঠাৎ একদিন বাপের ট্রলার গাঙে ডুবে যায়। সেই থেকেই মোর লেখাপড়া শেষ। তারপর থেকে বাপের ঋণ পরিশোধ করতে তার সঙ্গে কাজ শুরু করি।

শুধু জীবনই নন, এই চরের আউয়াল, তোফাজ্জেল, কামরুল, সজলসহ অর্ধশতাধিক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতে আসতে একসময় হয়ে উঠছে দক্ষ শ্রমিক। আবার কেউ জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন এখানে। অল্প টাকায় বেশি কাজ করানো যায় বলে কেউ কেউ নিজ এলাকা থেকে শিশু নিয়ে আসে এই চরে। স্থানীয় শিশুদের প্রতিদিন ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা শিশুদের সঙ্গে করা হয় মৌসুমী চুক্তি।

এরকমই এক কিশোর তোফাজ্জেল। এসেছে সাতক্ষীরা থেকে। শুধু তোফাজ্জেলই নয়, আরও দু’জন আছে তার সঙ্গে। তোফাজ্জেল পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে এই চরে কাজ করছে। বছর চারেক হলো তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সজল ও কামরুল।

তোফাজ্জেল বাংলানিউজকে বলে, পড়ালেখা করার কথা যখন, তখন টাকার পিছে দৌড়াইছি। স্থানীয় দূর সম্পর্কের চাচার সঙ্গে প্রথম এই চরে আইছিলাম। তখন পেটেভাতে কাজ করতাম। তারপর বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়ে এখন এই খানে কাজ করছি। হের লগে চুক্তি হইছে। এরপর কার লগে কাম করমু কইতে পারি না।

এই চরের বাসিন্দা মোবারক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা কোনো শিশুকে জোর করে আনি না। পরিবারে আর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকায় তারা এই চরে আসে কাজের সন্ধানে। কাজ করে অর্থ নেয়। শিশুরা না এলে আমাদের কোনো আপত্তি নাই, আমরা অন্য লোক দিয়ে কাজ করাবো।

স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, বছরের অর্ধেক সময় যেহেতু এখানে অস্থায়ী ঘরবসতি গড়ে তোলে কয়েকশ’ পরিবার, তাই এসব এলাকায় শিশুদের জন্য স্যাটেলাইট স্কুল স্থাপন জরুরি। ফলে, যেসব শিশু শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, তাদের শিক্ষার অধিকার সুনিশ্চিত হবে।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রিপন বাংলানিউজকে বলেন, সাগর উপকূলের বিভিন্ন চরাঞ্চলের শুটকি শিল্পকে কেন্দ্র করে যেমন টিকে থাকে দেশের ফিড মিলগুলো, তেমনি টিকে থাকে বাংলাদেশের ডেইরি, পোল্ট্রি ও মৎস্য সেক্টরও। তাই শুটকি শিল্প বিকাশে সাগর উপকূলের শুটকিপল্লীগুলোতে মানবিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবে এমন প্রত্যাশা আমাদের।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বাংলানিউজকে বলেন, শুটকি চরের বাসিন্দারা যেহেতু অস্থায়ী। তাই এই চরের শিশু কিংবা কিশোরদের শিক্ষার ব্যাপারে এখনও সরকারিভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুকুমার চন্দ্র হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, দুর্গম চর এলাকায় নতুন করে স্কুল স্থাপন ও পুরনো মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোকে সরকারি সহযোগিতার আওতায় আনার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন স্কুল স্থাপনে সরকার সহায়তা দিচ্ছে। তবে, এদের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৬
পিসি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।