ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

জন্ম থেকেই অবহেলিত উপকূলের নারী

সুমন শিকদার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৬
জন্ম থেকেই অবহেলিত উপকূলের নারী ছবি : বাংলানিউজটোয়েটিফোর.কম

বরগুনা উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে: যেখানে জন্ম থেকেই বঞ্চনা আর অবহেলার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হয় নারীদের। পুতুল খেলার বয়সেই যেতে হয় স্বামীর ঘরে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরুলেও উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন থেকে যায় অধরা। কর্মসংস্থানের অভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে কাটাতে হয় আমৃত্যু।

অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অজানা। ঘরের কোনে মুখ লুকিয়ে সবকিছু সহ্য করাই ওদের জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও মজুরির বেলায় বঞ্চিত হয় নারী শ্রমিক‍রা। জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। জন্ম থেকে বঞ্চনা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে উপকূলের নারীদের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরা হলো।

শিক্ষা ক্ষেত্রে উপেক্ষিত নারী:
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হলেও নারীরা এখনো শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এ অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে নারীদের শিক্ষার চেয়ে সাংসারিক কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় বেশি। তাই সংসার ধর্ম সামলাতে নারীকে বেশি শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয় না। কোনো মতে প্রাথমিকের গন্ডি পার করেই ইতি টানা হয় তার শিক্ষা জীবনের। আবার কোনো কোনো চরাঞ্চলে দেখা যায় প্রাথমিকের গন্ডিও পার করেন না দরিদ্র বাবা-মা।

কোনো কোনো শিক্ষিত বাবা-মা তার কন্যা সন্তানকে লেখাপড়া শিখালেও অধিকাংশ দরিদ্র ও অশিক্ষিত বাবা-মা তার কন্যা সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তানের শিক্ষায় গুরুত্ব দেন বেশি।

অন্যদিকে কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করার পরিবর্তে দেওয়া হয় সাংসারিক  কাজের শিক্ষা। ফলে প্রতিনিয়ত সে গড়ে ওঠে একজন বিনা পারিশ্রমিকের কর্মজীবী নারী হিসেবে।

চরাঞ্চলে বাল্য বিয়ের শিকার নারী:
চরাঞ্চলে দ‍ারিদ্র আর নারীর প্রতি অবহেলার কারণে বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে উপকূলীয় নারীরা। উপকূলের অধিকাংশ পরিবারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। আর্থিক টানাপড়েনের শিকার এসব দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে এখানকার অমোঘ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখানে কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবে দেখেন তারা। তাই এ বোঝা যত দ্রুত বিদায় করা যায় ততোই ভালো।

উপকূলীয় এলাকায় মেয়েদের সাধারণ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে অনেকটাই দায়মুক্ত হতে চান বাবা-মা। ফলে অপরিণত বয়সের এ বিয়ের কারণে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগেন এ অঞ্চলের নারীরা। বিশেষ করে অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে নারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। মায়ের কারণে অপুষ্ট ও বিকলাঙ্গতাসহ নানা সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের জন্ম নেওয়া শিশুদের। এমনকি, বাল্যবিয়ের কারণে বিচ্ছেদ ও মৃত্যুও এখন হরহামেশাই ঘটছে উপকূলে। সংসারেও দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা।

কর্মসংস্থানের অভাবে পরনির্ভরশীল নারী:
উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের নেই কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাই অন্যের উপর ভর করে কাটাতে হয় তাদের আজীবন। উপকূলের কোথাও নারীদের জন্য নেই আলাদা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী থেকে লাভবান হচ্ছেন পুরুষরা। পুরুষকে ঘিরেই করতে হয় তার যাবতীয় কাজ। কেননা এটাই তো চিরায়ত রীতি। পুরুষ ভোগে আনন্দ পাবে আর নারী ত্যাগে।

কখনো কখনো কোনো নারী আত্মনির্ভরশীল হতে চাইলেও তাকে পড়তে হয় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। ব্যবসা, চাকরি এমনকি দিনমজুরি কাজেও তাকে নির্ভর করতে হয় একজন পুরুষের উপর। তার নেই কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে শুধু পরাধীনতার বন্ধন। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে  নারীদের জন্য নেই কোন মার্কেট। নেই চাকরি কিংবা ব্যবসায়ের সুযোগ সুবিধা। তাই প্রতিনিয়ত পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে পরিশ্রম করেও তাদের থাকতে হচ্ছে পরনির্ভরশীল হয়ে।

ন্যায্য পরিশ্রমিক বঞ্চিত নারী:
বরগুনাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা ঘরের পাশাপাশি বাইরেও পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন। কিন্তু সমানতালে কাজ করেও নানাভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ নারী শ্রমিকরা। এছাড়াও বাইরের কাজে রয়েছে বিপদে পড়ার নানা  ঝুঁকি। তবুও জুটছে না ন্যায্য পারিশ্রমিক।
উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তারা কৃষি, জেলে, ব্যবসা এমনকি দিনমজুরির কাজেও পুরুষের পাশাপাশি সমান ভূমিকা রাখছেন। তবুও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এ শ্রমজীবী নারী।

এর উপর রয়েছে হয়রানি। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কোলের বাচ্চা থাকলে তাদের কাজে নেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কুপ্রস্তাব দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবুও সংসারের প্রয়োজনে নারী শ্রমিকরা এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দিনরাত কাজ করে চলেছেন।

দুর্যোগ ঝুঁকিতে নারী:
উপকূলের যেকোনো দুর্যোগেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন নারীরা। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসী নানান ঝুঁকি নিয়ে তটস্থ থাকলেও তাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে। নারী সদস্যরা জানে না দুর্যোগে টিকে থাকার কৌশল। পারে না প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে। বিশেষ করে উপকূলীয় নারীদের পরিধেয় পোশাকের কারণে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের তালিকায় থাকা  দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এ ক্ষতিকর প্রভাবে অসহায় শিকারে পরিণত এদেশের চরাঞ্চলের নারীরা। সম্প্রতি বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ধারণার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলীয় মানুষ।

নারীদের অধিকার আদায় ও  ভাগ্য উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন উপকূলীয় উন্নয়ন সংগঠন জাগো নারী। জাগো নারীর ফান্ড রাইজিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার ডিউক ইবনে আমিন বাংলানিউজকে বলেন, জন্ম থেকেই অবহেলিত উপকূলের নারীরা। শিক্ষা, অন্ন বস্ত্র বাসস্থান থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা অবহেলিত। নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে উন্নয়ন সংগঠনসহ সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

নারী নেত্রী বিথী হাওলাদার পুজা বাংলানিউজকে বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভেতর থেকে আমরা যতদিন বের না হতে পারবো ততোদিন আমরা আবহেলিত রয়ে যাবো। তাই প্রথমে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শিকল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মেহেরুন নাহার মুন্নি বাংলানিউজকে বলেন, নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই, তারা নিজেরা এখন সচেতন। তবে চরাঞ্চলে নারী-পুরুষের মধ্যে এখনো কিছু বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। ভবিষতে এগুলোও থাকবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩১ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৬
আরএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।