ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

চাঁদের হিসাবই নদীর ভাষা

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
চাঁদের হিসাবই নদীর ভাষা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গাবুরা (শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) থেকে: নদীতে দিনের গণনা চলে গুণের হিসাবে। ১৫ দিনে এক গুণ।

এই গুণ হিসাব করেই জীবিকা চলে খোলপেটুয়া নদী তীরের মানুষদের। সঙ্গে আকাসের চাঁদ আর বাতাসের গতিবিধির হিসাব বলে দেয় নদীর প্রকৃতি।

বনের ভিতরে কিংবা সাগরেরর কাছাকাছি নদীতে থাকার সময় কোস্টগার্ড বা নৌপুলিশের কাছ থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেলে না সবসময়। তখন প্রাকৃতিক এসব নিয়মই তাদের জানান দেয় নদীর কথা। সে হিসেবেই তরী ভাসান জেলেরা।

গত ২৬ জুন থেকে সুন্দরবন ঘেঁষা নদী খোলপেটুয়ার অববাহিকায় গাবুরা ও পদ্মপুকুরের জেলেদের সঙ্গে ঘুরে ও কথা বলে জানা যায় নদীর গতি-মর্জি বুঝতে তাদের এসব নিজস্ব ব্যবস্থার কথা।

ষাটোর্ধ্ব আফসার রহমান এখন আর নৌকা ভাসান না, মাছও ধরেন না, সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ বা গোলপাতা কাটতেও যান না। তবে নদীর পানির হিসাব তার নখদর্পনে।

চাঁদের রূপ দেখে যেমন গুণের হিসাব বলে দেন, তেমনি মৌমাছির মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন মৌচাকে মধুর খবর। আর কোথায় কোন সময় কাঁকড়া বা মাছ ভালো পাওয়া যাবে সেও তার জানা।

বাংলানিউজকে আফসার রহমান বলেন, এগুলো বলে বা লিখে শেখানো যায় না, নদী আর বনে যেয়ে যেয়ে শিখতে হয়। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে শেখা।

তিনি বলেন, মাসে দু’টা গুণ আসে। এটা হিন্দুদের পঞ্জিকা অনুযায়ী চাঁদ দেখে। দশমি থেকে গুনের জন্ম, অমাবশ্যায় মৃত্যু। গুণ আসে অমাবশ্যা আর পূর্ণিমার পাঁচ দিন আগে থেকে। অমাবশ্যা আর পূর্ণিমার পর তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয়ে চতুর্দশীতে মৃত্যু হয় গুনের। চাঁদের হিসাব রাখলেই এই হিসাব পরিষ্কার।

গুণের সময় নদীতে জোয়ার থাকে বেশি। এ সময় জাল মাছ টানে বেশি। কাঁকড়া, বাগদা, সাদা মাছ, চিংড়ি ধরা পড়ে অনেক।

আফসার বলেন, মরা গুণে নদীতে পানি থাকে কম, স্রোতও কম। এ সময়টা জেলেদের জন্য ভালো না।

অষ্টমী তিথিতে তখন চাঁদের আকর্ষণে যেখানে জোয়ার হয় সূর্যের আকর্ষণে সেখানে ভাটা হয়। সেখানেও মরা গুণ থাকে।

নদীর জোয়ার-ভাটারও হিসাব আছে। নদীর পানি দিনে দুইবার ওঠা-নামা করে। কখনও পানি ফুলে জোয়ার হয়, কখনও নেমে ভাটা হয়, এসবই সূর্য আর চাঁদ দেখে বোঝা যায়। আর একবার হিসাবটা চলে এলে, এরপর এমনি মাথায় কাজ করে এটা।

বৃদ্ধ এই জেলে বলেন, গুণের সময় নদী থেকে আয় যেমন ভালো তেমনি ডাকাতের কবলে পড়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এইতো দু’দিন আগে গুণ না আসতেই এক জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে ডাকাতেরা।

এ সময়টায় বন থেকে বেরিয়ে আসে ডাকাতেরা, জানান তিনি।

ঝড়ের বিষয়ে এই বৃদ্ধ জেলে বলেন, ঠাণ্ডা বাতাসই জানান দেয় ঝড় আসবে। আর তা যদি আসে দক্ষিণ দিক থেকে তাইলে ভয়াবহ। উত্তরের বাতাসে ভয় বেশি থাকে না।

মাছের গতিপথ দেখেও বোঝা যায় ঝড়ের গতি-বিধি। বড় দুর্যোগের আগে মাছেরা উপরে উঠে আসে। বিশেষ করে ছোট মাছ। সে সময় একটা থমথমে আবহাওয়া থাকে। আমরা বুঝতে পারি।

এরপর বলতে শুরু করলেন মধুর খবর।

‘যে মৌচাক থেকে দেখা যাবে মৌমাছিরা ঘাড় কাৎ করে বের হচ্ছে, বোঝা যায় মৌচাকে মধু রয়েছে। আর ঘাড় সোজা করে বের হলে বোঝা যাবে, সেখানে মধু নেই। আর গাছের পাতায় যদি দেখা যায় মধু লেপ্টে আছে, সেখানে ঝুঁকি রয়েছে বাঘের,’ এক নাগারে বলে যান এই অভিজ্ঞ মৌয়াল।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে তালপট্টি, দ্বীপচর ছাড়াও যতো সাগরের দিকে যাওয়া যায় সেখানে মাছ বেশি পাওয়া যায় বলে জানান জীবন থেকে শিখে নেওয়া এই মানুষটি।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৬ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
এমএন/এমএ/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।