ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

উপকূল থেকে উপকূল

জলদস্যুরা সর্বহারা পেশাছাড়া করছে জেলেদের

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৬ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
জলদস্যুরা সর্বহারা পেশাছাড়া করছে জেলেদের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পাথরঘাটা (বরগুনা থেকে): ‘মোরা পানির লগে (সঙ্গে) যুদ্ধ হরে (করে) বাঁইচ্যা থাহি। তয় ডাকাতের (জলদস্যু) লগেই পারি না।

ধরা পড়লেই শ্যাষ, ট্যাহা (মুক্তিপণ) দিতি গিয়া ভিডা-মাটি, টিনের চাল, জাল-নৌকা-ট্রলার সব বেঁচতি হইবো। এরপর এনজিও’র লোন, মাহাজনের দাদন- সারা জনমেও শ্যাষ অয় না। জেলও খাটতে অয়। সবশেষে জাইলের কাম ছাইড়া-ছুইড়া ঘরে বহে ম্যালাজন’।
 
বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-বলেশ্বর পাড় আর সুন্দরবন তীরবর্তী উপকূলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হতদরিদ্র জেলেদের বক্তব্য এরকমই। নিঃস্ব-সর্বহারা হয়ে পেশা হারাচ্ছেন তাদের অনেকেই।  
 
সাগরে-নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হয়ে প্রথমেই মাছ ধরার রসদ খুইয়ে পরে আর পানিতে নামার সক্ষমতা থাকছে না এসব জেলেদের। এরপর জলদস্যুরা একটি নৌকা-ট্রলারের এক বা একাধিক জেলেকে আটকে রাখে। পরে গভীর সমুদ্রে বা সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে বন্দি জেলেদের প্রচণ্ড মারধর করা হয়। মোবাইল ফোনে তাদের আর্তচিৎকার শুনিয়ে মুক্তিপণ পাঠাতে বলা হয়। বাধ্য হয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন স্বজনেরা।

সাধারণত মাছ ধরার নৌকা চালনাকারী মাঝি বা সরদারকে ধরে মুক্তিপণ আদায় করে জলদস্যুরা। আর সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর‌্যন্ত দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয় অপহৃতদের।

সহায়-সম্পদ বিক্রি করেও জলদস্যুদের চাহিদামতো টাকা যোগাড় না হওয়ায় এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। পরিণামে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ অনেককে এনজিও’র মামলায় জেলও খাটতে হয়। এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ফেরারি জীবনেও বাধ্য হন কেউ কেউ। এক এনজিও’র ঋণ শুধাতে অন্যটি, সেটি থেকে বাঁচতে আরেকটি থেকে ঋণ নেন প্রায় সকলেই। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে ঋণ-সুদের বোঝা।

মুক্তিপণ না পেয়ে জেলেদের নির্মমভাবে হত্যা করে হাত-পা বেধে সাগরে ফেলে পর‌্যন্ত দিচ্ছে জলদস্যুরা। গত বছর সুন্দরবনের কাছে বঙ্গোপসাগরের নারিকেলবাড়িয়া অংশে চার জেলেকে এভাবেই হত্যা করা হয়।  

পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামের বাজারে পদ্মা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুল মজিদ মিয়া (৭০), গ্রাম্য মুরুব্বি নূরুল আলম (৬৫), এক সময়কার জেলে আলতাফ মাঝিসহ (৫০) বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেল- ‘এই দ্যাশে যতো লোক আছে সবাই ঋণি। ডাকাতের কবলে জাইল্যের থনে সর্বহারা হইছে যারা, তারা অহন আর পানিতে নামতে পারে না, কেউ বেকার থাহে, কেউ অন্যের জমির কামলা আর কেউ দোহানদারি করে’।    
 
তাদের মধ্যে এক সময়ের নামকরা মাঝি আলতাফ এখন আর জেলে নন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন- ‘ডাহাইতে ধইরা মাইরলো, টাহা চাইলো পরিবারের কাছে। বোট-জাল-দড়ি সব বেইচ্যে শুধলো সে টাকা। আর আমি হইলাম বেকার। তয় হারিকানা-বাদুরতলা-পদ্মার খালে ছোটখাট মাছ ধইরতে নামি, জাইলে আছিলাম যে’।  
 
বাবা-ছোট ভাই আর নিজে মিলে ১৬ মেয়াদে মেম্বার আব্দুল মজিদ মিয়ার পরিবার। ট্রলার মালিক আর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব নিয়ে সপ্তাহখানেক আগেও নিজের দু’জন জেলেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন। কিন্তু নিরাপত্তার চিন্তায় কতো টাকা দিতে হয়েছে- সে বিষয়ে মুখ বন্ধ তার।  
 
মো. জালালকে (২৫) বলেশ্বর নদের কচিখালী পয়েন্ট থেকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। তাকে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে সহায়-সম্পদ বিক্রি করতে হয়েছে তার অসহায়-দরিদ্র পরিবারটিকে। আগে ট্রলার মালিক ছিলেন জালালের বাবা, ইলিশ ধরতে যেতেন বঙ্গোপাসাগরে। এখন জালাল ছোট ভাই রিপনকে নিয়ে কোনোমতে ছোট নৌকা সমেত যান বাড়ির পাশের বঙ্গোপসাগর-বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরের মোহনায়।
 
‘আগে মাইঝ্যালি করছি, পশ্চিমে বলেশ্বর পাড় হইছি, সুন্দরবন পর‌্যন্ত গিয়ে জাল বাইছি, আর অহন ডাকাতদের জন্যি কূলে উঠছি। চা বেইচ্যা কুনোমতে খাই’- বলছিলেন কবির নাজির(৪০)। জলদস্যুদের কাছে সব খুইয়ে জেলে জীবন গেছে তার। পদ্মা বাজারে অন্যের কাছ থেকে ছোট দোকান ভাড়া নিয়ে এখন হয়েছেন দোকানি। এনজিও’র কাছে এখনও দেনা দেড় লাখ টাকা। কিস্তি না পেয়ে মামলা করে তার বাবা-মাকে জেলও খাটিয়েছে ওই এনজিও।  
 
মতলেব নাজিরের (৭০) কাহিনী আরও করুণ- ‘দু’বার জলদস্যুরা আটকেছে বড় ছেলেকে। প্রথমবার ছাড়াই সিডরের পর পাওয়া ঘরের চাল বেইচ্যা। দ্বিতীয়বার টাহা দেইনি, ট্রলার দিয়ে ছাড়িয়েছি। পরে জমি বেইচ্যা আর এনজিও-মাহাজন-আড়তদারদের কাছ থেইক্যা ঋণ নিয়ে ছেলেকে ওমানে পাঠিয়েছি। অহনও সাড়ে চার লাখ ট্যাহা দেনা’।     
 
ওমানে আকামা পেয়ে কাজ-কর্ম করে ছেলে টাকা পাঠাবে, সেই টাকায় ঋণ শোধ করে টিকে থাকতে পারবেন- এই একটাই স্বপ্ন দেখেন নয়জনের বড় পরিবারের দায়িত্ব কাধে থাকা বৃদ্ধ মতলেব।
 
সদর ইউনিয়নের চরদুয়ানি ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানি বয়োজ্যেষ্ঠ ইসমাইল হাওলাদার (৬৬) পানিতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগে। তবে একই গ্রামের বাদল (৩৫), দুলাল (২৫), রেজাউল (১৫) ও তার বাবা জাফর (৩৯) টাকার অভাবে মৌসুম শুরুর অনেক পরে মাছ ধরার নৌকা প্রস্তুত করছিলেন।    
 
এলাকাবাসী জানান, র‌্যাব-কোস্টগার্ড-পুলিশ আর বনবিভাগের তৎপরতায় এখন জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কম। গত বছর ক্রসফায়ারে মারা গেছে আটজন। সম্প্রতি সাঁড়াশি অভিযানের লক্ষ্যে স্থাপিত হয়েছে পদ্মা স্লুইচ বাজার অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি। তবে এখনও জ্বালাচ্ছে তিন বাহিনীর ৫৬ জন জলদস্যু।
 
সিডর বিধ্বস্ত উপকূলীয় পাথরঘাটাকে ঘিরে রেখেছে ১১৭ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধ। নদী-সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিকে কেন্দ্র করেই এ উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষের জীবনযাপন। বাঁধের ভেতরে-বাইরের গ্রাম-জনপদের এসব মানুষের জীবন-জীবিকা মাছ বিশেষ করে ইলিশ মাছনির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলজ-বনের হিংস্র প্রাণীর হামলা আর ডুবে মরার ভয়-আতঙ্ককে পায়ে দলে নিয়ত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগর, বিষখালী-বলেশ্বর নদী বা বেশ কয়েকটি খালের পানিতে নামতেই হয় তাদের। কঠোর পরিশ্রমী-সংগ্রামী মানুষগুলো পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকে।
 
শুধু ডাকাত-জলদস্যুদের হাতেই পরাজিত হতে হয় তাদের। তাইতো ট্রলার ও মাছ ব্যবসায়ী আব্বাস (২৫), কালছার (১২), রহমান খাঁ (২৭), রহিম মুন্সী (৩৩) এবং জাহাঙ্গীর (২৮) বলছিলেন- ‘পদ্মা স্লুইচ বাজারের অস্থায়ী ফাঁড়িকে স্থায়ী করলে আমরা শান্তিতে থাকবো’।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১৬
এএসআর/

** পানির দেশে পানির আকাল!
** ইলিশ এলে জাগবে পাথরঘাটা, অপেক্ষায় মানুষ
** ‘প্যাড বাঁচাইতে বাঁচাইতে শ্যাষ, পিঠও বাঁচবো না’
** সেই কালরাতের ক্ষতচিহ্ন মোছেনি এখনও
**  পানিতেই জীবন, পানিতেই মরণ!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।