ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

অযত্নে-অবহেলায় শিক্ষাবঞ্চিত মানতা শিশুরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭
অযত্নে-অবহেলায় শিক্ষাবঞ্চিত মানতা শিশুরা অযত্নে-অবহেলায় বড় হচ্ছে ভোলার নদীতে নৌকাভাসি মানতা শিশুরা। ছবি: বাংলানিউজ

ভোলা: মেঘনা তীরে সারি সারি নৌকার বহর। বাঁধে খেলছে ১০/১২ জন শিশু। পরনে জামা-কাপড় নেই, পুরো শরীর কাদা-মাটিতে ভরা। পাশেই শিশুদের মায়েরা রান্না ও বাবারা জাল গোছাচ্ছেন।

নোংরা-অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে শিশুরা খেলায় মেতে উঠলেও বাধা দিচ্ছেন না বড়রা। এ অবস্থায়ই নৌকায় খেতে যায় কয়েকজন শিশু।

এভাবেই দিনের পর দিন আর বছরের পর বছর ধরে অযত্নে-অবহেলায় ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে ভোলার নদীতে নৌকাভাসি মানতা শিশুরা। কাদা মাখা শরীরে খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া, রাতে ঘুমানো আর নোংরা পানিতে গোসলেই নিত্যদিনের জীবনযাপন। অভিভাবকদের উদাসীনতায় আদর-যত্নের পাশাপাশি লেখাপড়া থেকেও বঞ্চিত ওরা। অপরিচ্ছন্ন-নোংরা পরিবেশে বেড়ে ওঠায় মেধা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব রয়েছে।

ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়া খাল, কাচিয়া ইউনিয়নের কাঠির মাথা, ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী এবং দৌলতখানের হাজিপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরে নৌকাভাসি মানতাদের বসবাস। ঠিকানাহারা এসব মানুষ নানা প্রতিকূলতার মুখেও পৈত্রিক পেশা ও জীবনযাপন ধরে রেখেছেন। তাই প্রজম্মের পর প্রজম্ম ধরে অবহেলায় বেড়ে উঠছে শিশুরাও।

নৌকায় রান্না, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ে, সন্তানদের লালন-পালন, এমনকি মৃত্যুও নৌকাতেই।  ছবি: বাংলানিউজ তবে ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী সংলগ্ন মানতাপল্লীতে গেলে কয়েকজন মানতা নারী দাবি করেন, শিশুবেলা থেকে তারাও এভাবে বড় হয়েছেন। নদীতে বসবাস করেন বলে শরীরচর্চার সময় নেই। রান্না, নৌকা বাওয়া ও মাছ ধরার কাজ নিয়েই তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়।

মানতারা জানান, নৌকায় রান্না, খাওয়া-দাওয়া, বিয়ে, সন্তানদের লালন-পালন, এমনকি মৃত্যুও তাদের নৌকাতেই। তাদের পেশা ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরে স্থানীয় ঘাটে বিক্রি করে সে টাকায় জীবিকা নির্বাহ করা। অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করায় শিশুরাও পাচ্ছে না শিক্ষার আলো, অযত্ন-অবহেলা ও নোংরা পরিবেশেই বড় হতে হচ্ছে।

যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড়ের যুদ্ধ, সেখানে ছেলে-মেয়েদের যত্ন নেওয়ার সময় নেই বলেও দাবি তাদের।

মানতা শিশু মালা বলে, ‘পড়ালেখার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু মানতা বলে আমরা পড়তে পারি না, বাবা-মাও পড়ার সুযোগ দেন না। নদীতে জাল ফেলা ও মাছ ধরা শেখান। কিভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবো- তা শেখান না’।

মঙ্গল জান বিবি বলেন, ‘৪ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে নৌকার সংসার আমার। ছেলেরা নদীর পাড়ে খেলাধুলা করে, আবার খাবার খেতে আসে, রাতে ঘুমায়। নদীর পানিতেই গোসল করে। আমরা যেভাবে বড় হয়েছি, তারাও সেভাবেই বড় হচ্ছে’।

শহর আলী সর্দার বলেন, ‘মেয়ে বড় হয়েছে, তাকে নৌকাতেই বিয়ে দেবো। কিসের আবার পড়ালেখা? আমরা যেভাবে আছি, তারাও সেভাবে সেই পরিবেশে বড় হবে’।

রোকেয়া বলেন, ‘আমাদের নানা সংকট। তবুও এক ছেলেকে স্কুলে নিয়ে গেছি, কিন্তু মানতা বলে তারা ভর্তি করেননি’।

যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার যোগাড়ের যুদ্ধ, সেখানে ছেলে-মেয়েদের যত্ন নেওয়ার সময় নেই, দাবি মানতাদের।  ছবি: বাংলানিউজমানতারা আরও জানান, সারাদিন নদীতে মাছ শিকারের পর তীরের কাছাকাছি নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা নোঙ্গর করা হয়। সেখানেই রান্না, খাওয়া-দাওয়া ও রাতযাপন। এক এলাকায় বেশিদিন থাকা যায় না, ২/৩ মাস থাকার পর আবার নতুন কোনো নদীর তীরে চলে যেতে হয়।

এভাবে দিন-মাস-বছর কেটে যায়, জন্ম নেয় নতুন আরেক প্রজম্ম। আগের পরম্পরায় তারাও বেড়ে ওঠে অযত্নে-অবহেলায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।