বরগুনার উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার রুহিতাসহ ৮টি প্রত্যন্ত গ্রামের এ দৃশ্য এখন প্রতিদিনের। অন্য শ্রমিকদের সহযোগিতা না নিয়ে নিজেরাই ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করেন গ্রামগুলোর দলবদ্ধ নারীরা।
এমনকি দুর্যোগকালীন দুঃসময়ের খাদ্য চাহিদা মেটাতে ‘ফুড ব্যাংক’ তৈরি করে নিজেদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য জমাও রাখছেন ওই নারীরা।
সরেজমিনে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, উপকূলীয় এসব প্রান্তিক জনপদে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে কৃষিকাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। দুর্যোগ মোকাবেলায়ও ভিন্নতা এনেছেন তারা। অ্যাকশনএইড ও সুশীলনের সহযোগিতায় তাদেরকে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিকের ড্রাম। ওই ড্রামেই ধান, চালসহ শুকনো খাবার সংরক্ষণ করছেন নারীরা।
সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা বিষখালী-বলেশ্বর নদী সংলগ্ন উপকূলের ৯০ শতাংশ মানুষই একটা সময় মাছের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু এখন কৃষি খামারেও কাজ করছেন তারা।
উপকূলবাসী বলছেন, প্রলয়ঙ্করী সিডর বিস্তীর্ণ এ জনপদের অনেক মানুষ ও গবাদিপশু-পাখির প্রাণ কেড়ে নেয়, ব্যাপক ক্ষতি করে ঘর-বাড়ির। ফসল নষ্টের মাধ্যমে তৈরি করে দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী প্রকট খাদ্য সংকটও। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় তারা খাদ্যহীন ছিলেন কয়েকদিন।
ফলে সিডর পরবর্তীতে পেটের তাগিদেই ক্রমে ক্রমে সচেতন হয়েছেন এখানকার মানুষ। মাছ শিকারের পাশাপাশি নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছেন উন্নত প্রযুক্তির কৃষিকাজেও। পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে মাঠে নেমে পড়ছেন নারীরাও।
বলেশ্বর নদ সংলগ্ন গাববাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার মাঠে মাঠে সোনালী রঙের পাকা ধান। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া উপেক্ষা করে মাঠের একপ্রান্ত থেকে দলবেধে ধান কাটা শুরু করেছেন নাছিমা বেগম, জয়নব বেগম, মমতাজ বেগমেরা। তাদের হাত চলছে কাচি দিয়ে ধান কাটার কাজে আর মুখে হাসি ও গানের কলি। কাটা শেষে ধান মাড়াই করে ঘরেও তুলছেন নিজেরাই।
পাথরঘাটা সদর ও চরদুয়ানী ইউনিয়নের ওই ৮টি গ্রামে অ্যাকশন এইডের সহযোগিতায় ‘সহিংসতা প্রতিরোধমূলক কাজে নারীকে সম্পৃক্তকরণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সুশীলন। এর আওতায় ২৫ জন করে মোট ২০০ নারীকে নিয়ে বিভিন্ন নামে ৮টি নারী দল গঠিত হয়েছে।
কৃষিকাজে নারীর অংশীদারিত্বসহ নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয়ে নানা প্রশিক্ষণ নেন এসব দলের নারীরা। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে বাড়ান সচেতনতাও। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে সার-বীজ দেয় সুশীলন।
চলতি মৌসুমে দলগুলোর সদস্যরা দুই ইউনিয়নের ১ একর ৪৮ শতাংশ জমিতে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ইরি ধান উৎপাদন করেছেন। এতে তাদের খরচের দ্বিগুণ লাভ হয়েছে বলে জানান রূপালী নারী দলের সভানেত্রী নাসিমা বেগম।
তিনি বলেন, ‘আগে মাছ ধরার কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করতাম। এখন আমরা সম্মিলিতভাবে সমানতালে কৃষিকাজ করছি। সফলতা পাওয়ায় নিজেদের আয় নিজেরাই জমা রাখি, খরচ করি। স্বামীর কাছে আর হাত পাততে হয় না’।
সুশীলনের পাথরঘাটা উপজেলা ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘কৃষিকাজে নারীর অংশীদারিত্বসহ নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয় নানা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমাদের পরামর্শ সব সময়ই অব্যহত থাকবে’।
পাথরঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিশির কুমার বড়াল বলেন, ‘সম্মিলিতভাবে কাজ করে দেশের জন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন নারীরা। এ কাজের ধারাবাহিকতা রাখতে তাদেরকে পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দেওয়া অব্যহত রাখতে হবে। আমাদের দফতর থেকেও নারীদের সব সময়ই পরামর্শ দিয়ে আসছি’।
ইসমাইল হোসেন ও শিশির কুমার বড়াল আরও জানান, দুর্যোগপ্রবণ বিস্তীর্ণ উপকূলে প্রতিনিয়ত আঘাত হানে বিভিন্ন মাত্রার সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেগুলো এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলায় প্রতিটি সংসারে সারা বছরই লেগে থাকে অভাব-অনটন।
কৃষিকাজে নারীদের এই সম্পৃক্ততা ও তাদের ফুড ব্যাংক অভাবের ওই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পুরো উপকূলবাসীকে সহায়তা করছে বলেও মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
এএসআর
** সম্মিলিত চাষাবাদে ভাগ্য গড়ছেন পাখিরা