বনের মধ্যে মাছ ধরেতে গেলেই নানান বাঁধা আসে। যে কারণে মাছ কম পাওয়া যায়।
মাছ ধরতে যাওয়ার পথে কয়েকজন জেলে জানান, সুন্দরবন এলাকার নদী ও খালগুলোতে বেন্দি, কারেন্ট, বুনো জাল দিয়ে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করছে সরকার। তারা মাছ ধরতে গেলেই প্রায় নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বন বিভাগের লোকজন তাদের বাঁধা দেয়। অনেক সময় জাল নিয়ে যায়। নৌকা আটকিয়ে রাখে। সোহেল রানা নামের এক জেলে বলেন, এহন আমাগো খারাপ দিন। নদীতে তেমন মাছ নাই । বউ পোলাপান লইয়া খুব কষ্টের মধ্যে আছি। মাছের ওপর সংসার চলে। যেদিন মাছ পাই হেই দিন বাজার করতি পারি। না পাইলে বাজার অয় না।
আব্দুল্লাহ মাতব্বর নামের অপর এক জেলে বলেন, এহানে অনেক কষ্টে থাহি আমরা। খাওয়ার মিঢা (মিষ্টি) পানি নাই, নাই কারেন্ট। মাছও জোডে (জোটে) না তেমন। আগের দিন এহন নাই। দেনা করতে করতে সবই হারাইছি।
তিনি জানান, সুন্দরবনের চরে বাঘের ভয় নিয়ে মাছ ধরতে যেতে হয় জেলেদের। নদীতে গিয়ে মাঝে মধ্যে কুমির পাওয়া যায়। বাঘ ও কুমিরের ভয় নিয়ে মাছ ধরতে হয়।
পাশে থাকা আরেক জেলে জিহাদুলের তথ্য মতে, এই জেলে পল্লীতে স্থায়ী প্রায় ৫ হাজার মানুষ থাকে। অন্যান্য এলাকা থেকে মাছের মৌসুমে আরও ৫ হাজার মানুষ আসে এখানে।
‘মাছ ধরি বদ্দর, হরিণটানা, আন্ধাররা ও মাইডা থেকে। আশে পাশে কোনো সাইক্লোন সেন্টার নাই। যেটা আছে তা অনেক দূরে। ঝড়ের সময় যহন সিগনাল (সিগন্যাল) দেয় তহন সেইহানে গিয়ে থাহি,’ বলেন জিহাদুল।
আরেক জেলে হাবিব বলেন, ২৫/২৬ বছর ধরে এহানে থাহি। বিভিন্ন কোম্পানি এই চরের জায়গা কিনে নিয়েছে। এইহানে থাকতে বছরে কিছু টাহা দেওয়া লাগে। মাছ, চিংড়ির পোনা, কাড়া (কাঁকড়া) ধরে খাই। পোনা ধরতে দেয় না। কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ ধাবড়ায়। জাল নিয়া যায়। জাল লইয়ে পুড়ায়ে দেয়।
‘আর মাঝে মধ্যে গলদা-বাগদার যে পোনা পাই তা বটতলায় বিক্রি করি। অন্য জায়গা দিয়ে লোক অইসে মাছ কিনে নিয়ে যায়। ’
তিনি বলেন, আমাদের এখানে মানুষকে বারো মাসই দূর থেকে খাবার পানি নিয়ে আসতে হয়। বর্ষার সময় খেতে হয় বৃষ্টির পানি।
সুন্দরতলা গ্রামের ঘের মালিক বিজন বৈদ্য বাংলানিউজকে বলেন, মাছ ধরে এখানকার জেলেরা তা জয়মনি, উত্তরজয়মনি, চিলা, পশ্চিমচিলা, বৈদ্যমারী বাজার, সুন্দরতলা, দক্ষিণ হলদিবুনিয়া, উত্তর হলদিবুনিয়া, মধ্য হলদিবুনিয়া, পূর্বচিলা ও মোংলা সদরের বাজারে বিক্রি করেন। তবে আগে যেমন তাদের জালে মাছ পাওয়া যেতো এখন ততটা যায় না। যে কারণে বাজারে মাছও কম।
সম্প্রতি জেলে পল্লী ঘুরে দেখা যায়, পল্লীতে বসবাসকারী জেলেদের অবস্থা বেশ নাজুক। দারিদ্র্যের কষাঘাতে তাদের যায় যায় অবস্থা। জাল ও নৌকা বানানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য অনেকের-ই নেই।
তাই বাধ্য হয়ে মহাজন বা আড়তদারদের কাছ থেকে নগদ টাকা দাদন নিয়ে জাল ও নৌকা তৈরি করেন অনেক জেলে। কমিশনের আশায় আড়তদার জেলেদের দাদন দিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে জাল-নৌকা কেনেন।
সংসার চালানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্যালা, পশুরসহ আশপাশের নদী-খালে মাছ শিকার করতে যান জেলেরা। যাদের ট্রলার আছে তারা গভীর সমুদ্রেও পাড়ি দেন। সকাল ৭টার মধ্যে জেলে পল্লী পূরুষ শূন্য হয়ে যায়।
নদীর ওপরই নির্ভরশীলতা থাকার কারণে জেলে পল্লী নদীর পাড় ঘেঁষেই গড়ে ওঠে। বারবার নদীর পাড় ভাঙা-গড়ার বিষয় থাকায় জেলেপল্লীর ঘরগুলোও অস্থায়ী কাঠামোর। আর উঠানের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অনেক ঘর-ই রয়েছে যেগুলো খড়কুটা ও গোল পাতার তৈরি।
যারা আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল তারা টিনের ঘর তৈরি করেছেন। জেয়ারের সময় পানি উঠে যাওয়ায় অনেকে টং ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন। ইলিশের মৌসুম চলায় জাল ও নৌকা তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে অনেক জেলেকে।
চিলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আকবর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তার ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পুরাটাই জেলে পল্লী (জয়মনীর ঠোটা)। যেখানে নদীর পাড়ে প্রায় পাঁচ হাজার দারিদ্র্যের শিকার জেলেরা বাস করেন।
‘তারা বনের ভেতরে ছোট-বড় খাল, নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করেন। প্রতিনিয়ত বাঘ ও কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে প্রকৃতিতে বেঁচে থাকতে হয় এসব মানুষকে,’ যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬ , ২০১৮
এমআরএম/এমএ