ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপকূল থেকে উপকূল

বাবার সমান কাজ করছে ঝরেপড়া শিশু সাইকুল

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯
বাবার সমান কাজ করছে ঝরেপড়া শিশু সাইকুল নৌকা থেকে পানি ফেলছে সাইকুল। ছবি: বাংলানিউজ

বিষখালী নদীর জ্বিনতলা থেকে ফিরে: বিষখালী নদী থেকে শাখা খাল বয়ে গেছে পশ্চিম দিকে। বিষখালী নদীর মতো ঢেউ নেই, তবে যে ঢেউ রয়েছে তাতেও ভয়ে আঁতকে উঠার মতো। আকাশের সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে, এমন সময় চোখে পড়লো বাপ-বেটার কর্মযজ্ঞ।

১০ বছর বয়সী শিশু সাইকুল বাবার সঙ্গে সমান অংশে কাজ করছেন। শাখা খালটি ভাটায় পানি কমে যাওয়ায় একমাত্র সম্বল নৌকাটি ঘাটে নোঙর করতে কখনো নৌকার পেছন থেকে ধাক্কা আবার কখনো মাঝি হয়ে দিক নির্ণয় দিচ্ছে।

ঠিক এমন মুহূর্তে কয়েকটি ছবি তুলতেই টের পেয়ে যায় শিশু সাইকুল। এ বয়সে ছবি তুলতে যদিও কৌতূহল থাকে তারপরেও উপায় নেই কাজ করতেই হবে।

পাথরঘাটা উপজেলার সদর পাথরঘাটা ইউনিয়নের চরলাঠিমারা গ্রাম। বিষখালী নদী ঘেষা জ্বিনতলা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বসবাস সাইকুল ইসলামের (১০) বাবা ইদ্রিস আলী তালুকদার। ৫ মেয়ে ও ২ ছেলে নিয়ে ইদ্রিস তালুকদারের সংসার। এক সময়ে তালুকদারী থাকলেও আজ নিঃস্ব। ১০টি বড় ট্রলারের মালিক ছিলেন ইদ্রিস। সেই কারণেই নামে সঙ্গে বংশের নাম হয়েছে তালুকদার। কিন্তু সেই তালুকদারী ভয়ঙ্কর সাগর সবশেষ করে দিয়েছে। নৌকা ধাক্কা দিচ্ছে সাইকুল।  ছবি: বাংলানিউজসরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, যে বয়সে খেলাধুলা আর বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা ঠিক সে বয়সেই জেলেপল্লির সাইকুলের মতো শিশুদের কোমল হাতে তুলে নিতে হয়েছে নৌকার বৈঠা। কোমল হাতে বইয়ের বিপরীতে কখনো নৌকার বৈঠা কখনো জাল টানতে হচ্ছে।

বিষখালী নদীরপাড়ের অধিকাংশ শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও এসব শিশু প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে না। শিশু বয়স থেকেই এদের অভিভাবকরা তাদের নদীতে মাছ শিকার করতে নিয়ে যাচ্ছে। নদীতেই হারিয়ে যাচ্ছে এদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

কথা হয় ৭০ বছর বয়সী ইদ্রিস আলী তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বেশিদিন আগেকার কথা নয়, মাত্র ১০ বছর আগেও আমার ১০টি মাছ ধরার জাল (বড় ট্রলার) ছিল। ভালো থাকতাম, ভালো খাইতাম। একে একে সব শেষ হয়ে গেছে। কয়েকটি ট্রলার সাগরে ডুবে গেছে, আর দেনায় জর্জরিত হয়ে ঋণ পরিশোধ করতেই সব শেষ হয়ে যায়। এখন আমার তালুকদারী তো দূরের কথা ছোট একটা নৌকা দিয়াই মাছ ধইরা সংসার চালাই।

তিনি আরও বলেন, ৫ মাইয়্যা আর এক পোলা বিয়া দিছি। যে যার মতো সংসার চালায়। আমি এই পোলাডা নিয়া থাহি। বাপ-দাদা পেশা ছাড়তেও পারি না। ছেলেকে লেখাপড়া করার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমার কাজে সহযোগিতা করছে ছোট ছেলে সাইকুল, অভাবের সংসারে ছেলেকে আর লেখাপড়া করাইতে পারি নাই। এখন বয়সের ভারে তেমন ভারী কাজ করতে পারছি না। নৌকা ধাক্কা দিচ্ছে সাইকুল।  ছবি: বাংলানিউজকথা হয় শিশু সাইকুলের সঙ্গে। সাইকুল বলে, ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েছি। ক্লাস থ্রিতে উঠবো এমন সময় বাপের সঙ্গে নৌকায় মাছ ধরা শুরু করি। ঝড়-তুফানের মধ্যেও বাপের সঙ্গে বিষখালী নদীতে মাছ ধরি। নদীতে ডুবে যাওয়ার ভয় থাকলেও কিছু করার নেই, ঘরে অভাব দূর করতেই নৌকায় শ্রম দিতে হচ্ছে।

স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা সংকল্প ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বাংলানিউজকে বলেন, উপকূলীয় জনপদে অভাবের তাড়নায় ও পূর্ব-পুরুষের পেশা না ছাড়তে পারায় শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া সচেতনতা না থাকাও একটা কারণ।

তিনি আরও বলেন, আমরা উপকূলীয় জনপদের ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষার দিকে আনতে শিশু স্কুল পরিচালনা করছি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।