খুলনা: ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ডুবেছিল খুলনার উপকূলীয় অঞ্চল। এতে ঘেরের চিংড়ি মাছ ভেসে গেলেও লবণ পানিতে রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ সাদা মাছ মরে ভেসে উঠেছে।
বিশেষ করে কয়রার মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও আশাশুনি উপজেলা, দাকোপ ও পাইকগাছার বেশ কয়েকটি গ্রামে লবণ পানির কারণে জমিতে থাকা ফসল, খড়কুটো, জলজ উদ্ভিদ ও পুকুর-ঘেরের মাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মিঠা পুকুরের পানিতে লবণ পানি ঢুকে কালচে হয়ে গেছে। আর এ পানিতে বংশবিস্তার করছে হাজার হাজার রোগজীবাণু। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ যখন এই দূষিত পানি পান করছে কিংবা গোসলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করছে, তখন তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ।
দক্ষিণ গোগরাকাঠির রেবেকা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, পুকুরের পানি কালো হয়ে গেছে। লবনপানিতে মাছ ও গাছ মরে যাচ্ছে। গাছের পাতা পুকুরের পানিতে পড়ে পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। পচা পানির দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
২ নম্বর বাগালী ইউনিয়নের বামিয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের বাংলানিউজকে বলেন, এলাকা জুড়ে বিশুদ্ধ পানির অভাব। মানুষ দায় থেকে লবণ পানি পান করছে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। পুকুর-ঘেরে লবন পানি ঢুকে মাছ মরে পচে উঠেছে। এতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাধ্য হয়ে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। কালচে পানিতে গোসল করে অনেকের চর্ম ও পানিবাহিত রোগ হচ্ছে। বিশেষ করে বামিয়া, দক্ষিণ গোগরাকাঠি ও শ্রীফলতলার পানির অবস্থা খুবই খারাপ। বিভিন্ন জিনিস পচে পানির ঘনত্ব বেড়ে গেছে। পচা দুর্গন্ধে দম নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
বামিয়া বিলের বেগম রুমা নামের এক গৃহিনী বাংলানিউজকে বলেন, নোংরা পানির কারণে আমার গায়ে চুলকানি হয়েছে। আমার মতো সাত বছরের ছেলেরও একই অবস্থা। চারপাশে এতো দুর্গন্ধ যে টেকা যাচ্ছে না।
পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি দেবব্রত দাস বলেন, অতিরিক্ত লবণের কারণে ঘেরের নানা ধরনের মাছের সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়া মরে গেছে।
পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোট খুলনার সদস্য সচিব ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, অতিরিক্ত লবণ পানির কারণে ফসলের ক্ষেত পচে গেছে। ঘের ও পুকুরের মাছও মরেছে অনেকের। লবণ পানি পানে মরেছে হাঁস-মুরিগসহ গবাদি পশু। পচা পানির দুর্গন্ধে উপকূলের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় বার বার ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে উপকূলের গ্রামগুলোতে। এতে প্রতিবারই পবিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে উপকূল। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা বার বার টেকসই বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দেয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না।
এদিকে উপকূল রক্ষায় বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনার উপকূল কয়রা ও পাইকগাছা এলাকা সরেজমিনে ঘুরেছি। বলতে গেলে প্রতিবছর উপকূল লণ্ডভণ্ড হয়। কপাল ভাঙে সাদাসিধে গরীবের। আর কপাল ভালো হয় গুটিকয়েক মানুষের। যাই হোক বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তের বিরূপ প্রভাবের হাত থেকে উপকূলের কান্না থামাতে কয়েকটি প্রস্তাবনা রাখতে চাই-
১। দেশের অনুমান ৬ হাজার কিলোমিটার উপকূলের বেড়িবাঁধ সংস্কার করে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। উদহারণ হিসেবে বলা যায়- কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ন্যায় দেশের উপকূলের বেড়িবাঁধের উপর মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা যেতে পারে।
২। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বাঘ হরিণসহ বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে বনের মধ্যে উঁচু আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে। যাতে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সময় পানি বৃদ্ধি পেলে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। মানুষের জন্য হাজার হাজার সাইক্লোন সেল্টার থাকতে পারলে বন্যপ্রাণীদের জন্য কেন নয়?
৩। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি, কৃষকদের সুদমুক্ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণসুবিধা দিতে হবে।
৪। উপকূল নিকটবর্তী সকল নদ-নদী, খালের নাব্যতা বৃদ্ধি করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে উপকূলে সবুজ বেস্টনী গড়ে তুলতে হবে।
৫। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে আরো কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০২১
এমআরএম/এনটি