ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন

ভৈরব থেকে মাহবুব আলম

‘হারা বছর হবর নাই, এবার বুইজ্জা হুইন্না ভুট দিয়াম’

মাহবুব আলম ও টিটু দাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
‘হারা বছর হবর নাই, এবার বুইজ্জা হুইন্না ভুট দিয়াম’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভৈরব থেকে: ‘হারা (সারা) বছর হবর (খবর) নাই, নির্বাচন আইলেই (এলে) হবর অয়। হিন্তু আর না, এইবার বুইজ্জা হুইন্নাই ভুট দিয়াম (কিন্তু এবার বুঝে শুনেই ভোট দেবো)’।

নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশ ক্ষিপ্ত হয়েই কথাগুলো বলছিলেন ভৈরব পৌর এলাকার ৭নং ওয়ার্ডের কমলপুরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মো. মোস্তফা।

বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামগামী চট্টলা এক্সপ্রেস থেকে মেঘনা-পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল ভৈরববাজার স্টেশনে নেমে দেখি সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলার চিন্তায় মগ্ন। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেলো নির্বাচনে পৌরবাসীর ভাবনা জানার অভিযান।

ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে ৪টা, মেঘনাপাড়ের বাসিন্দারা শীতের মিষ্টি রোদ মাথায় নিয়ে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ বা আবার পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে বসে আড্ডায় মত্ত।

সেখানে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুকের পাশাপাশি চলছিল নির্বাচনের নানা বিষয়ে তর্কের ঝড়।

শহরের পূর্ব কমলপুরের জারু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে গল্পে মেতেছিলেন ৭৫ বছর বয়সী মুরশীদ আলম ও নূর মিয়া। তাদের কথার ‍মূল বিষয় আসন্ন পৌর নির্বাচন। দু’জনে আলাপ চালিয়ে গেলেও পাশে অনেকেই বসে মুগ্ধ শ্রোতার মতো সায় দিচ্ছিলেন।

মুরশীদ বলেন, ‘ভুট হারে দিয়াম হেইডা মনেই আছে। যারা হারইছে (প্রার্থী হওয়া) দেখতাছি হগলেই ভালা। গতবার শাহিন মিয়া হাস (জয়ী) করছিন, এইবার আক্কাস মিয়াও হারইছে। দেহি হারে ভুট দেওয়ন যায়’।

বাংলানিউজের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এইবার হেলা হাস হরবো হেইডা হিতা হইয়াম (কে পাস করবো সেটা কী বলবো), একটা মনে হরলে আরেকটা অয়। ধানের শীষ, নৌকা হোনো ঝামেলা নাই। আগাইয়া আছে দু’জনই’।

তার সঙ্গে যোগ করে ভৈরব সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ডের চটপটি বিক্রেতা কবির হোসেন বললেন, ‘অহনও বুঝি নাই, তবে দুইজনই কঠিন প্রচারণা চালাইতেছে। আগাইয়াও আছে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই অইবো মনে অইতাছে’।

এবার ভৈরব পৌরসভায় আওয়ামী লীগ থেকে অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাস এবং হাজী মো. শাহিনকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি।

নির্বাচনী প্রতীক নৌকা, ধানের শীষ হলেও তাদের ব্যক্তি ইমেজও ভোটে বেশ কাজে দেবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এলাকায় তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। তাছাড়া বিএনপি প্রার্থী হাজী মো. শাহীন বর্তমানে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।

ভৈরব হাজী হাসমত কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র বাকি বিল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, বিএনপির প্রার্থী গতবারও বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আক্কাসও বেশ জোরেসোরে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এগিয়ে আছেন দুইজনই। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি এগিয়ে থাকবে।

‘তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বেশ ভালো পর্যায়ে আছে- যোগ করেন তিনি’।

কাকে ভোট দেবেন আর যারে ভোট দেবেন সেই প্রার্থীর কাছে চান কী? এ জিজ্ঞাসার উত্তরে ম্লান হেসে এই কলেজ ছাত্র বলেন, ‘কী আর চাইবো ভাই। ভোট আমার অধিকার সেইটাই দেবো। নির্বাচনের আগে সবাই আসে, কিন্তু জয়ের পরে তো কাউকেই পাবো না। চেয়ে আর কি হবে’?

ভৈরব বাজারের টিনপট্টিতে যখন বাকি বিল্লাহর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে জড়ো হন আরও কয়েকজন। তাদের একজন সাইফুল ইসলাম,  নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন তিনিও। জানালেন, নিউ মার্কেট এলাকায় তার বাসা, জন্ম-গ্রামের বাড়ি কটিয়াদী হলেও ব্যবসার খাতিরে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এখানেই তাদের বাস। নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশের অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র ভৈরব বাজারে তাদের মনিহারি ব্যবসা আছে।

তিনি বললেন, ভৈরব জনসংখ্যার দিকে কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে বড় পৌরসভা। রয়েছে শিল্প কারখানাও। তাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন দলীয়ভাবে হলেও এখানে দলের প্রভাবের চেয়ে স্থানীয় কিছু বিষয় বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তার মধ্যে রাস্তা না থাকা, সংস্কার, পানি সরবরাহ, অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ, নোংরা পরিবেশ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, মাদক উল্লেখযোগ্য।

‘এসব কাজের জন্য ভোটাররা যে প্রার্থীকে অধিকতর যোগ্য ও আন্তরিক মনে করবেন, তাকেই ভোট দেবেন,’ বলেন সাইফুল।

এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে টিনপট্টি গোপাল জিউর মন্দিরের সামনে পথসভা করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাস।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করছেন বিএনপি প্রার্থী হাজী মো. শাহিনও। তবে এলাকায় রাস্তা-ঘাট সংস্কার ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় ভোটারদের মধ্যে শাহিনকে নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।

স্টেশন এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘ভোট আসে, ভোট যায়। আগে নেতা, প্রার্থীদের মুখে শুধু প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের কথা চলে। বিরোধী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণের বুলিও আওড়ান। কিন্তু ভোট পর্ব শেষ হয়ে গেলে কেউ খবর নেন না। এমনকি দেখলেও কথা বলেন না’।

এতোক্ষণ স্টলে বসে চুপচাপ ছিলেন পাশে বসে থাকা স্থানীয় চা বিক্রেতা জারু মিয়া (৬০)। এবার মুখ খুললেন তিনি।

‘মহিলা মাদ্রাসার হামনের সড়কে তো চলাই যায় না। বিষ্টি-বাদল অইলেই এই সড়ক দিয়া বাসায় যাইতাম হারি না অইলে, কেউ তো ঠিক কই দিলো না, বেশ ক্ষোভ ঝেরে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

‘এর হরেও বিশ্বাস কইরা আমরা হেরারে ভুট (ভোট) দেই। এইবার ইসাব (হিসাব) কইরা ভুট দিয়াম’। একই কথা বলেন স্থানীয় পান বিক্রেতা রহমত উল্লাহ ও আকবর আলীও।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী পৌর নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ভৈরব উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুব আলম জানান, পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৫৫ জন অংশ নিচ্ছেন। আর সংরক্ষিত আসনে ১৪ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী এ পৌরসভায় মোট ৬৭ হাজার ৪৩৬  ভোটারের বাস। এরমধ্যে পুরুষ ৩৩ হাজার ৬৮৬ এবং নারী ভোটার রয়েছেন ৩৩ হাজার ৭৫০ জন। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘ক’ শ্রেণীর এ পৌরসভায় মোট ৩৫টি কেন্দ্র রয়েছে।

** ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা

বাংলাদেশ সময়: ১০২৯ ঘণ্টা,ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এমএ/আরএইচএস/আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।