ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

নির্বাচন

বাজিতপুর থেকে মাহবুব আলম

ত্রিমুখী লড়াইয়ে সরগরম ভোটের মাঠ

মাহবুব আলম ও টিটু দাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
ত্রিমুখী লড়াইয়ে সরগরম ভোটের মাঠ ছবি: শাকিল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ভাগলপুর (বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ) থেকে: বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে আসন্ন নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন আশরাফ ও বিএনপি মনোনীত এহেসান কুফিয়ার সঙ্গে নির্বাচনী দৌড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী শওকত আকবরও আলোচনায় রয়েছেন।


 
১৫ দশমিক ৩১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাজিতপুর পৌর এলাকা ডোবা আর পুকুরে ভরপুর। এখানে বাস করেন ৯১ হাজার ৯১৩ মানুষ। বাজিতপুর পৌরসভায় ১২টি কেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ২১ হাজার ৩০ জন।

রাস্তা-ঘাটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, ব্যাটারি চালিত অটো-রিকশায় চড়লেই তা বোঝা যায়। ভাঙা রাস্তায় চলতে গিয়ে একটি মোটরসাইকেল উল্টে পড়ার দৃশ্যও দেখা গেল। নাগরিক সুবিধা বলতে যা বোঝায় তা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাচ্ছেন না ভোটাররা।
 
এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল সিনেমা হল মোড়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী উজ্জ্বল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমান মেয়র বিএনপির। এবারও তিনি ধানের শীষে প্রার্থী হয়েছেন। এলাকার খুব একটা উন্নয়ন করতে পারেননি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের হওয়ায় বর্তমান মেয়র ঠিকমতো কাজ করতে পারেননি বলেও মনে করেন ওই ব্যবসায়ী।
 
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে পারিবারিক ঐতিহ্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে নির্বাচনী মাঠে এগিয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শওকত আকবর এবং বিএনপির প্রার্থী এহেসান কুফিয়া।
 
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন আশরাফের বড় ভাই স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন। ভাই সরকার দলীয় সংসদ সদস্য হওয়ায় নির্বাচনী মাঠে তার প্রভাব বিস্তার হতে পারে বলে অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকরা।
 
ভাইয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পৌর এলাকার বাইরে থেকে লোকজন এনে প্রতিদিন শোডাউন ও জনসংযোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
 
এরপরও ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা খসরু মিয়া নির্বাচনে এগিয়ে রাখছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে। তিনি বলেন, দল ক্ষমতায়; পাস তো নৌকাই করবে। তবে সুষ্ঠু ভোট চাই, আমরা কেন্দ্রে যাইতাম চাই।
 
একই মার্ক‍া দিলেন স্থানীয় একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা খসরু মিয়াও। তিনি বলেন, প্রথম স্থানে আছে নৌকা, দ্বিতীয় স্থানে ধানের শীষ আর তিন নম্বরে আছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। আরেকজন প্রার্থী আছে ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের, যার নাম মনেই থাকে না!
 
তবে চন্দ্রগ্রাম মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বসে চুপচাপ অন্যদের কথা শুনছিলেন ৯নং ওয়ার্ডের আরেক বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া। চন্দ্রগ্রাম মোড় ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্র।  
 
নীরবতা ভেঙে বাচ্চু মিয়া বলে ওঠেন, সরকার দলের প্রার্থী হলে এলাকার উন্নয়ন হবে, বিরোধী দলের প্রার্থী হলে তা হয় না। অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। এবার তাই নতুন চিন্তা করছি আমরা।
 
‌‘রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন আর নিরাপদে থাকতে চাই আমরা। মেয়রদের কাছে তো আর টেহা-পয়সা চাই না’- বলেন তিনি।
 
তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাদশা মিয়া বললেন, মানুষ যারে ভালো মনে করে তারেই ভোট দেবে। এটাই আমি চাই।
 
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডের সফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা উন্নয়ন চাই না, শান্তি চাই। ছোট্ট এই শহরটায় মাদক, সন্ত্রাসী আর অসামাজিক কার্যকলাপে ভরে গেছে। আমরা এর থেকে উত্তরণ চাই।
 
বর্তমান মেয়র ও বিএনপি দলীয় প্রার্থী এহেসান কুফিয়া বলেন, ৫ বছর পর পর নিবার্চন হয়। নিবার্চনকে কেন্দ্র মানুষের মধ্যে ঈদের থেকেও বড় আনন্দ বিরাজ করে। কিন্তু জোর জবরদস্তি করে তা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।  
 
অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমি প্রচারণা করতে পারছি না। এক জায়গায় জনসংযোগ করতে গেলে সরকার দলের লোকজন গিয়ে বাধা দেয়। এমনকি গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমারে পিস্তল দেখিয়ে হুমকি দেয় তারা।
 
আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শওকত আকবরও। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় আমার লোকজনকে হেনস্তা করা হচ্ছে। এমনকি বাইরে থেকে লোক এনে কেন্দ্র দখলেরও ফন্দি আটছে এমপি ও তার ক্যাডাররা।

তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন আশরাফ। আচরণ বিধি মেনেই নিয়মানুযায়ী তিনি প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত এই প্রার্থী।  
 
ফ্যাক্টর হবে ‌‘রিজার্ভ ভোট’:
বাজিতপুর পৌরসভাকে বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে শাসন করেছেন দুটি পরিবার। তাদের ‘রিজার্ভ ভোট’ নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দেয় প্রতিবার।
 
কিন্তু এবারের নির্বাচনে ভোটের হিসাব কী হবে? ‘রিজার্ভ ভোট’ না অন্য কিছু? এ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে পৌর শহর জুড়ে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নতুন মুখ আনোয়ার হোসেন আশরাফ দুই পরিবারের স্থায়ী আসনের দখল নিতে কী সক্ষম হবেন? এমন আলোচনায় বাজিতপুরের নির্বাচনী মাঠ সরগরম।
 
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন বর্তমান মেয়র এহেসান কুফিয়া। তার বাবা আব্দুল্লাহ বোরহান কুফিয়াও পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন চারবার।
 
অন্যদিকে তিনবারের সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মিজবাহউদ্দিন আহাম্মদের ছেলে শওকত আকবরও এবার মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলেও এলাকায় তার পরিবারের ‘ভোট ব্যাংক’ আছে বলে জানান স্থানীয়রা।

এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আফজাল হোসেনের ছোটভাই আনোয়ার হোসেন আশরাফ। উপজেলা যুবলীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত নির্বাচনে পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি মো. এহেসান কুফিয়া ছিলেন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। ওই সময় ৬ হাজার ৬৮৪ ভোট পেয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। সে সময় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মজিবুর রহমান মঞ্জু সমর্থিত প্রার্থী লায়ন আমিরুল হোসেন সুজন পান এক হাজার ৩৫৪ ভোট।

ওই নির্বাচনে মেয়র এহেসান কুফিয়ার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সারওয়ার আলম। কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন পাঁচ হাজার ৯৫৩ ভোট। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. রফিকুল ইসলাম গোলাপ পেয়েছিলেন এক হাজার ৪৪৩ ভোট।

২০১০ সালের পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন গুরুত্ব পায়নি। তাই ভোটাররা নিরপেক্ষ ও নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীদের ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচন করেছেন। তবে এবার বিষয়টি আলাদা। রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি মনোনয়নে প্রার্থী দেওয়ায় বাজিতপুরে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে ‘প্রতীক’ আর প্রার্থীর সঞ্চিত ভোট ব্যাংক।

ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাজিতপুর পৌরসভায় নির্বাচনী লড়াই জমে উঠবে বলেই ধারণা করছেন ভোটাররা। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে ভোটকেন্দ্রে যেতে চান স্থানীয় ভোটাররা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
এমএ/এমজেএফ/

** আ’লীগ-বিএনপি নয়, লড়াই ‘ইছা-পচার’
** ‘হারা বছর হবর নাই, এবার বুইজ্জা হুইন্না ভুট দিয়াম’
**  ডিজিটাল নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।