পল আদ্রিয়ান ফন মেকেরিন। নেদারল্যান্ডসে জন্ম, এখন থাকেন যুক্তরাজ্যে।
রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন পল। এরপর তাকে ‘তোমার হাসির কথা পড়েছি, আজ দেখলাম..’ বলতেই জমে উঠল গল্প। নেদারল্যান্ডসের এই ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান বাপ্পি।
বাংলানিউজ: আপনার হাসির ব্যাপারে অনেক শুনেছি, আজ সামনাসামনি দেখতেও পারলাম...
পল: (মুখে হাসি নিয়ে) আমি প্রতিদিনই হাসার চেষ্টা করি। এটা কিন্তু ভালো। সবারই উচিত নিয়ম করে হাসা। আপনিও করতে পারেন...
বাংলানিউজ: এক বছর আগেও তো এমন হাসি ছিল না। উবার ইটসে কাজ করতেন। তখন মনে হয়েছিল আর ক্রিকেট ফিরতে পারবেন?
পল: স্বপ্ন দেখতাম তো অবশ্যই। জানতাম ফেরার মতো ভালো ক্রিকেটার আমি। কিন্তু তখন চারদিকে করোনা ঘিরে ধরেছে, ক্রিকেটের সুযোগই কম ছিল। শক্ত নিয়ম ছিল কাউন্টি ক্রিকেটে। শীতে টিকে থাকার জন্য কিছু করতেই হতো। উবার ইটস ওই সুযোগটা করে দিয়েছিল।
ওই সময় কাজটা আসলে উপভোগও করেছি। আবার যদি কখনো বাড়তি টাকার দরকার হয়, এই কাজ করতে দ্বিধা করবো না। কিন্তু যুক্তরাজ্যের রাস্তার চেয়ে এখানকার কাজটায় (ক্রিকেটে) থাকাটাকেই বেশি ভালো মনে হচ্ছে।
বাংলানিউজ: তখন টিকে থাকা কঠিন ছিল, ক্রিকেটও। কংক্রিটের ফুটবল পিচে নাকি অনুশীলন করতেন। এই ভাবনা কোত্থেকে এলো?
পল: লকডাউনে আমার জাতীয় দলের সঙ্গে নেপালে আসার কথা ছিল। ইনডোর ফ্যাসিলিটিজ তখন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। আমার শরীরকে কোনোভাবে তৈরি করতে হতো বোলিংয়ের জন্য। এরপর কংক্রিটের ফুটবল পিচে ব্ল্যাক শিট বসিয়ে বল করতে শুরু করলাম। জানি না এটা কতটুকু সাহায্য করেছে। কারণ নেপালে খুব একটা ভালো যায়নি।
কিন্তু এটা শুধু কেবল ইম্প্রোভাইজ, নতুন আইডিয়ার ব্যাপার ছিল। যেন তৈরি ও ফিট থেকে খেলতে নামতে পারি। আমার মনে হয় এটা খুব দারুণ; আরও কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপার নিয়ে কাজ করেছি। কারণ আপনার কখনো কখনো কী ফল আসবে, তার দিকে তাকালে হবে না। মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে আমরা বেশিই চিন্তা করে ফেলি আমরা।
আমি শুধু নিজের শরীর ও বল করার সময় এর অনুভূতির ব্যাপারেই খেয়াল রাখি। এর বাইরে কিছু না। অনলাইন অ্যাপে এক কোচের সঙ্গে কথা হতো। উনি কিছু ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল। সেগুলো মেনেই তখন খেলতে গিয়েছিলাম।
বাংলানিউজ: ক্রিকেটের শুরু কীভাবে হলো?
পল: আমার বাবা ক্রিকেট খেলতেন। নেদারল্যান্ডসের বাকি ছেলেদের মতোই উনি ফুটবল শুরু করেছিলেন। উনার ক্লাবে ক্রিকেটও ছিল। পরে বাবা সেটাকে বেছে নেয়। আমিও শুরুতে দুটাই খেলতাম। কিন্তু একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছি।
বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসে তো সবাই ফুটবলই খেলে। আপনার না খেলায় কি আফসোস হয়?
পল: নেদারল্যান্ডসে ফুটবল সবার রক্তে আছে, আর ফিল্ড হকি। ক্রিকেট নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ। আমাদের খুব বেশি ছেলে নেই যারা ক্রিকেট জানে। ফ্যাসিলিটিজও তেমন নেই। সাধারণত ফুটবল পিচে আর্টিফিশিয়াল উইকেট বসিয়ে ক্রিকেট খেলি। ক্রিকেট খেলায় নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয় তবুও। অনেক বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলেছি। আশা করি সামনে আরও ডাচ ছেলেরা ক্রিকেটে আসবে।
বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটের অবস্থা এমনিতে কেমন?
পল: আমস্টারডামে বেড়ে উঠেছি আমি, ওখানকার কথা বলতে পারি। টিভিতে, পত্রিকায়, ওয়েবসাইটে কোথাও ক্রিকেট নেই। আমি ঘরোয়া ক্রিকেট দেখেই বেড়ে উঠেছি, ওখানে আমার নায়করা খেলতেন। পরে ১৬-১৭ বছর বয়সে টিভিতে ক্রিকেট দেখা শুরু করেছি। ছয় বছর ধরে যুক্তরাজ্যে আছি। এখানে তো ক্রিকেট আছে। তবে দলের দিকেই নজর রাখতে চাই।
বাংলানিউজ: ব্যাটার না হয়ে বোলিং বেছে নিলেন কেন?
পল: আমার মনে হয় এটাতে কিছুটা ভালো ছিলাম, এজন্য (হাসি)। ছোটবেলায় অবশ্য একটু ব্যাটও করতাম। কিন্তু প্রতি বলেই ছক্কা হাঁকাতে যেতাম, এটাই ছিল সমস্যা। এজন্য হয়তো কোচরা আর ব্যাটিংয়ের কোচিং করাতে চায়নি...। বোলিং কিছুটা প্রকৃতিগতভাবেও পেয়েছি। লম্বা ছিলাম, পেস বোলারদের জন্য এটা বাড়তি সুবিধা। গতিও ছিল।
যখন কোনো ছেলে ক্রিকেট বল হাতে নেয়, ব্যাটিং-বোলিং দুটাই করে। এরপর যত দিন আগায়, একটাতে উন্নতি করতে শুরু করে। বোলার, ব্যাটার, অলরাউন্ডার হয়। আমার জন্য ব্যাপারটা একই ছিল। বোলিংটা ছিল স্বভাবজাত। এরপর আস্তে আস্তে ব্যাটিংয়ের ধারটা কমে গেল।
বাংলানিউজ: আপনার কী মনে হয়, পেস বোলিংটাই ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজ?
পল: আমার তো তাই মনে হয়, শরীরের জন্য অনেক কঠিন। ব্যাটাররা সবসময় বলে- বোলার হওয়া সহজ। প্রতিদিন একই ব্যাপার করতে হয়। মানসিকভাবেও ততটা কঠিন নয়। আমি বোলার হিসেবে বলতে পারি, পেস বোলাররা ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন কাজ করে। একই সঙ্গে এটা আনন্দেরও- যদি আপনার গতি থাকে।
বাংলানিউজ: নেদারল্যান্ডসে তো পেসারের মতো ক্রিকেটার হওয়াও কঠিন? সবাই তো ফুটবলের দেশ হিসেবেই চেনে...
পল: আমি ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। ক্রিকেটের চেয়ে বেশি পছন্দও করতাম। কিন্তু বড় হতে হতে ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছি। ক্রিকেট থামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম একসময়। কিন্তু বাবা বললো আরেকটা বছর চেষ্টা করো। এরপর আর ছাড়া হলো না।
বাংলানিউজ: ফুটবলে কোন দল সমর্থন করেন?
পল: আয়াক্স। আর কোন দল করবো? আমস্টারডমে বেড়ে উঠেছি। ছোটবেলা থেকেই দল এটা...
বাংলানিউজ: আপনি একটু আগে বললেন নেদারল্যান্ডসে আপনাদের নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। প্রত্যাশার চাপ না থাকাটা তো বাড়তি সুবিধাও?
পল: আমার মনে হয় যখন বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দলগুলোর বিপক্ষে খেলি। তারা টেস্ট দল, আমাদের ওপর কোনো চাপই থাকে না। কারণ সবাই আগে থেকেই ধরে নেয়, হেরে যাবো। এরপর আমাদের একটা জিনিসই করার থাকে- আপসেট। এটা কিছুটা স্বাধীনতা দেয়।
নেদারল্যান্ডসে আমাদের কোনো প্রচার নেই মিডিয়ায়। যখন আপনি অন্য সহযোগী দেশগুলোর বিপক্ষেও খেলবেন, মিডিয়া থাকে পুরো পৃথিবীতেই। আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে যা করে- একটা ম্যাচ হেরেই কখনো কখনো আপনি টাকা পাবেন না; ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি খেলতে পারবেন না। এজন্য বিশ্বকাপের বাইরে সবসময়ই আমাদের চাপে থাকতে হয়। হারিয়ে ফেলার চাপ!
বাংলানিউজ: আপনার ইয়র্কারটা খুব ভালো। বেক থ্রু এনে দেওয়ার জন্য সুখ্যাতি আছে। এটা কীভাবে হলো?
পল: শুধু অনুশীলন, এর বাইরে কিছুই না। যখন আপনি এই পর্যায়ে খেলবেন, প্রতিদিন মাঠে নামবেন; কেবল অনুশীলন করে যেতে হবে।
বাংলানিউজ: যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বের জন্য নাকি দৌড়ঝাঁপ করছেন, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চান?
পল: এখন অবধি না। নাগরিকত্বও তো পেলাম না। অনেক নিয়ম আছে... ৯০ দিনের বেশি বাইরে থাকা যাবে না বা এমন। আপাতত কেবল কাউন্টিতেই মন দিতে চাই। এরপর দেখা যাক কী হয়!
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০২৩
এমএইচবি/এমএইচএম