ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

নির্বাচনের মুখে দলগুলোর ইশতেহার প্রকাশ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৪
নির্বাচনের মুখে দলগুলোর ইশতেহার প্রকাশ ছবি: সংগৃহিত

কলকাতাঃ দোরগোড়ায় ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ইতোমধ্যে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে নিজেদের বিস্তারিত মতামত তুলে ধরেছেন।

যার মধ্যে রয়েছে- অর্থনীতি, সামাজিক বিষয়, বৈদেশিক নীতি, শিল্প, কৃষি, সংস্কৃতিসহ দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার প্রতিফলন।

ভারতের  জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশের বয়স ৩৫ এর নীচে। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে এই তরুণরাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এই তরুণদের নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন উঠে এসেছে ইশতেহারে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন ইশতেহারে। নিজের দল নির্বাচনে জয় লাভ করলে কোন কোন বিষয়ে কি কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেই বিষয়েও স্পষ্ট মতামত প্রকাশ পেয়েছে।

আর বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই তারা নির্বাচকদের কাছে ভোটের জন্য আবেদন করছেন। নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার খতিয়ে দেখলেন বাংলানিউজ২৪-এর কলকাতা প্রতিনিধি ভাস্কর সরদার।

ভারতের অন্যতম দল জাতীয় কংগ্রেসের ৪৮ পৃষ্ঠার ইশতেহারে জাতীয় কংগ্রেস তাদের বিগত দিনে সম্পন্ন কাজগুলোর সঙ্গে আগামী দিনের পরিকল্পনা তুলে ধরেছে।

কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীর ভাবনায় এই ইশতেহার করা হয়েছে। কংগ্রেসের তরফ থেকে বলা হয়েছে ইশতেহারে কি কি বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে রাহুল গান্ধী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। এর মধ্যে যেমন আছেন বিভিন্ন গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান, কৃষক, শ্রমিক, রিক্সা চালক, পিছিয়ে পড়া জনগণ তেমনি আছেন সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষও।

গোটা বিশ্ব এখনও সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরোতে পারিনি। অন্যান্য দেশের মত ভারতের অর্থনীতিও এই মন্দায় বেশ কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত। ফলে এখনও শতভাগ চাঙ্গা নয় ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা। সেই বিষয়কে সামনে রেখে কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রাকে ৮ শতাংশ নিয়ে যাবার।

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাত ভারতের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। জাতীয় কংগ্রেসের ইশতেহারে বলা হয়েছে জিডিপি’র ৩ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে।

বিগত মেয়াদে কংগ্রেসকে সবচেয়ে বেশি যে ইস্যু নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম মুদ্রাস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ে সরকারকে গোটা সময়কাল ধরেই বার বার বিরোধীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার বিষয়টি ইশতেহারে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে এবার।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল মেয়াদে সময় কংগ্রেস শাসিত নরসীমারাও সরকারের আমল থেকে যে  মুক্ত অর্থনীতির কথা বলে এসেছে জাতীয় কংগ্রেস সেই মুক্ত অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে এবার। কৃষি ক্ষেত্রে ভারতকে বিশ্বের এক নম্বরে নিয়ে যাবার প্রত্যয় উঠে এসেছে।

বিদ্যুৎ, পরিবহন, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে আগামী দশ বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে সমস্ত গ্রামে ইন্টারনেট এবং ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবার কথা ইশতেহারে প্রকাশ করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা এবং সুরক্ষিত সঞ্চয়ের কথা মাথায় রেখে সকলের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস।

সকলের জন্য শিক্ষার অধিকারকে সুনিশ্চিত করা এবং "স্কুল ছুট" কমিয়ে আনার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। এছাড়া অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে।

২০১২/২০১৩ সালে ভারতে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে প্রবল হলে বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয় কংগ্রেস সরকারকে। বিরোধীরা এই ঘটনাগুলোকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলে দাবী করতে থাকে।

অপরদিকে নারীদের সংরক্ষণ বিলও পাশ করাতে ব্যর্থ হয় সরকার। এ কারণেই ‍এবার নারী সংরক্ষণ বিল পাশ করানো তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য বলে উঠে এসেছে ইশতেহারে।

শতকরা ৫৬ ভাগ ভারতীয় মহিলা অ্যানিমিয়ার শিকার। দেশের বিরাট অংশের মহিলাদের সঠিক পুষ্টির বিষয়ে এবার সরকার গঠন করতে পারলে অত্যন্ত জোর দেবে তারা। এছাড়াও খুবই গুরুত্ব পেয়েছে পিছিয়ে পড়া তালিকাভুক্ত জাতির সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি।

নারীদের সুরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অপর যে বিষয়টি সরকারের কাছে গলায় কাঁটার মত আটকে ছিল সেটি হচ্ছে দুর্নীতি। একদিকে টু জি, কমনওয়েলথ গেমস অন্যদিকে কোলগেট নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ।

তাই এবার কংগ্রেসের ইশতেহারে আগামী দিনে দুর্নীতি দমন আইন কঠোরভাবে বলবৎ করার কথা বলা হয়েছে।  

সকল ক্ষেত্রে ন্যুনতম মজুরি চালুসহ শ্রমিকদের জন্য বিশেষ নীতি প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে। উঠে এসেছে নতুন ১০ কোটি চাকরি তৈরি করার কথাও। রাজ্যগুলোকে স্বনির্ভর করে তোলার দিকেও জোর দেওয়া হয়েছে।

সংখ্যার হিসেবে ৩৫ বছর বয়সের নীচে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি।   বিপুল এই তারুণদেরকে কাজে লাগাবার জন্য কংগ্রেস চেষ্টা করবে বলে ইশতেহারে লেখা হয়েছে।

জাতীয় ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। যা ‍অভিনব বলেও মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তরুণদের মাদক ও নেশা মুক্তির বিষয়টিতেও জোর দেওয়া হয়েছে।

বৃদ্ধদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ ও বিমা চালুর পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও দেশের সব বিদ্যালয়ে আধুনিক শৌচাগার তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।   শিশুদের অধিকারের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করার কথা এবং শিশু পাচার রোধসহ শিশু শ্রমিকদের উন্নতির জন্য সব রকম ব্যবস্থার কথা প্রকাশ করা হয়েছে।

শিক্ষার মান উন্নয়ন, আই টি শিক্ষার প্রসার, সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উন্নতির কথাও বলা হয়েছে।  

কৃষির ক্ষেত্রে জৈবসার ভিত্তিক চাষে গুরুত্ব দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষিজাত পণ্যের দাম এবং শিল্পের জন্য জমি দিতে হলে কৃষকদের সঠিক ক্ষতিপূরণ দেবার বিষয়টি ইশতেহারের মোটা দাগে এসেছে।

“কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট” বিগত সরকারের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল। তাই এবার রপ্তানিমুখী বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। তাই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি বাণিজ্যকে অত্যধিক গুরুত্ব দেবার কথা উঠে এসেছে।

শিল্পের ক্ষেত্রে অঞ্চল ভিত্তিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশকে আলাদা আলাদাভাবে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।   জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে ‘জাতীয় সোলার মিশন’ এবং  ‘জাতীয় হাওয়া মিশন’ তৈরির কথা বলা হয়েছে।

পরিবেশ এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রটিকেও গুরুত্ব দিয়েছে কংগ্রেস। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তিতে জিডিপি’র ২ শতাংশ খরচের লক্ষ্যমাত্রাকে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে।

বিদেশ নীতি নিয়ে বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে কংগ্রেসের ইশতেহারে। বলা হয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে আরো সুসম্পর্কের উপর জোর দেওয়া হবে। ‘ইউনাইটেড নেশন সিকিউরিটি কাউন্সিল’–এর স্থায়ী সদস্য হবার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে কংগ্রেসের ইশতেহারে।

এছাড়া উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। চীনের সঙ্গেও সীমান্ত সমস্যার বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

অপরদিকে শ্রীলঙ্কায় তামিলদের সমান অধিকারের দাবীর বিষয়টিও উঠে এসেছে। আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়ায় সরকার গড়তে পারলে কংগ্রেস সমর্থন করবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রথম দফার ভোট শুরু হতে মাত্র তিনদিন বাকি থাকলেও ভারতের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেনি। তবে যে মূল বিষয়গুলো বিজেপি সামনে এনেছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করলেই বিজেপি’র রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার অভিমুখ অনুমান করা যায়।

বিজেপি’র ভোটের মূল বিষয় “মোদী মন্ত্র”। কিন্তু কি এই মোদী মন্ত্র”?

দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা , সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া, টেলিকম সেবার উন্নতি এই মন্ত্রের মূল বিষয়।

বিজেপি’র দাবি তারা ক্ষমতায় এলে বাড়বে জীবন যাত্রার মান, হবে অর্থনীতিক উন্নতি। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে ভারতের ২৬টি শহরকে ‘বুলেট ট্রেন’ এর মাধ্যমে জোড়ার কথা বলা হয়েছে।

এরপরেই এসেছে সুশাসনের কথা। তার মধ্যে যেমন আছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা= তেমনি আছে যুবকদের চাকরি এবং কর্ম সংস্থান। শুধু উচ্চশিক্ষিত যুবকরাই নয় বিজেপি সরকার গড়লে অল্পশিক্ষিত যুবকদের কারিগরি প্রশিক্ষণের কথাও তাদের বক্তব্যে এসেছে।

বিজেপি‘র পরিকল্পনার  মধ্যে এসেছে দেশের সব বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পরিসেবার প্রতিশ্রুতি। এর সঙ্গে বিজেপি জানিয়েছে সারা দেশের সব কয়টি রাজ্যে গড়ে তোলা হবে ‘আই আই টি’ এবং ‘আই আই এম’ –এর মত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বিজেপি খুব বেশি করে সামনে এনেছে ‘গুজরাট মডেলকে’। বেশি চাকরির ব্যবস্থা, সকলের জন্য বেশি পরিমাণে রোজগার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, সকলের জন্য শিক্ষা এবং সকলের জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা গুজরাট মডেলের অন্যতম বিষয়।

এছাড়া বিজেপি বিশেষ জোর দিচ্ছে কৃষি এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য এবং মহিলাদের উন্নতির ক্ষেত্রে। সকলের জন্য পরিষ্কার পানীয় জল, সেতু ও রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রগুলোও বিজেপি’র প্রতিশ্রুতির অন্যতম অংশ।

দেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে জোর দিয়েছে বিজেপি। তারা জানিয়েছে নিরাপত্তা বিষয়ের বিভিন্ন সামগ্রী দেশে তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। এর ফলে কমবে বিদেশি প্রযুক্তির নির্ভরতা এবং যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই খাতে খরচ হয় সেটি থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। ফলে সুদৃঢ় হবে অর্থনীতি।

বিজেপি আরও জানিয়েছে দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে মানবতার দৃষ্টি-ভঙ্গি নিয়ে তারা তাদের সরকার পরিচালনা করবে।

এরপর আসছে- তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস এখনও জাতীয় দলের সমতুল্য নয়। তবুও এই কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্যই প্রথম সারির একটি রাজনৈতিক দল। গত লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ১৯টি আসন। অনেকেই মনে করছেন একক সংখ্যার বিচারে যদি সরকার গঠন না হয় সে ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস একটি বড় ভূমিকা নিতে পারে।

ইশতেহার প্রকাশ করে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মত দিক গুলোর প্রতি নজর রাখছেন। তাদের ইশতেহারে বলা হয়েছে ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা। জোর দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলোর ক্ষমতায়নের স্বপক্ষে। অনগ্রসর শ্রেণির উন্নতির দিকে তৃণমূল কংগ্রেস নজর দেবে বলে জানানো হয়েছে।  

মুসলিমদের উচ্চশিক্ষায় গুরুত্ব প্রদান, মুসলিমদের নিরাপত্তা, স্থানীয় ভাষার স্বীকৃতির কথাও জোরের সঙ্গে ইশতেহারে বলা হয়েছে।

মহিলা এবং শিশুদের উন্নতির কথা বলা হয়েছে। তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কোন পরিকল্পনার কথা উঠে আসেনি। ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ এবং ‘কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওর’ আইনের বদল করার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়াও ভৌগলিক অবস্থান ভিত্তিক চাকরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া খুব স্বাভাবিক ভাবেই জোর দেওয়া হয়েছে মূল্যবৃদ্ধি বিষয়কে।   রান্নার গ্যাস এবং সারের দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ইশতেহারে খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের সরাসরি বিরোধিতা করা হয়েছে। শুধু তাই নয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিষয়টিতেও পরিষ্কার বিরোধিতা করা হয়েছে ইশতেহারে। বিরোধিতা করা হয়েছে বর্তমান জমি অধিগ্রহণ আইনেরও।

সরকার জোর করে কৃষকদের কাছ থেকে জমি নিতে পারবে না। যদিও এই অবস্থান তৃণমূল কংগ্রেসের নতুন নয়। মূলত জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান। তাদের মতে কারখানার মালিক পক্ষ সরাসরি চাষির কাছ থেকে জমি কিনে শিল্প স্থাপন করবে। তবে এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে প্রায় প্রথম সারির সব কটি রাজনৈতিক দল। তাদের মতে এর ফলে উৎপত্তি হবে মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীর।

তৃণমূল কংগ্রেস জোর দিয়েছে লোকপাল এবং লোকায়ুক্ত গঠনের বিষয়টিতেও।

পরের ধাপে তৃণমূল কংগ্রেস রেখেছে নির্বাচনী সংস্কার বিষয়টি। এখানে মিল পাওয়া যায় কংগ্রেসের দাবীর সঙ্গেও। তৃণমূল কংগ্রেস দাবী করছে সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন খরচ খরচার বিষয়টি উপর।

যেখানে সরকারের দেওয়া টাকায় অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় তহবিলের মাধ্যমে নির্বাচনের সমস্ত খরচ নির্বাহ করবে রাজনৈতিক দলগুলো। এরফলে কর্পোরেটদের দেওয়া টাকা বা বেআইনি খাতের টাকা নির্বাচনে খরচ করতে পারবে না রাজনৈতিক দলগুলো।

দেশের শত ভাগ জনগণকে পরিষ্কার পানীয় জল দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ভারতের যে মেধাবীরা দেশের বাইরে কাজ করছেন তাদের তথ্য জমা করে “ট্যালেন্ট ব্যাংক” তৈরি করার পরিকল্পনা করছে তৃণমূল কংগ্রেস।

জিডিপি’র ৮ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এর মধ্যে থাকবে কারিগরি শিক্ষাও।

আরও একটি অভিনব পরিকল্পনার কথা তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে ঘোষণা করেছে। সেটি হল অনগ্রসর শ্রেণি নয় কিন্তু আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, অর্থাৎ উচ্চ বর্ণের গরীব মানুষদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করার কথা। এছাড়া আছে দেশের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা।

খাদ্য-শস্য এবং পাটের সঠিক দাম যাতে চাষিরা পায় সেই ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা বলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দেশের চাষিদের সার্বিক উন্নয়নের কথাও এই ইশতেহারে বলা আছে। আছে কৃষি ঋণ মওকুফের প্রস্তাবনাও।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপর জোর দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বড় শিল্পের মধ্যে বিদ্যুৎ, খনি, আই টি ইত্যাদিতে জোর দেওয়া আছে।

পরিবেশ সুরক্ষা এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ইশতেহারে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে আনা হয়েছে।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এবং কোহিমা থেকে দ্বারকা পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কথা বলা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে জলপথ পরিবহনে।

জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আদিবাসীদের জন্য সুবিধা জনক আইন তৈরি করার কথা হয়েছে। জল বিদ্যুৎ এবং সৌর শক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

অনাদায়ী কর ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। রাজ্য গুলোর কাছে থেকে করের টাকা দেশের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নতুন আইনের প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে।

বিদেশ নীতি নিয়ে বিশেষ কিছু না বললেও সকল দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সীমানা সমস্যার সমাধানের কথা বলেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

এবার দেখা যাক- সিপিএম’র ইশতেহার। গত লোকসভা নির্বাচনে গোটা ভারতে সিপিএম’র দখলে ছিল ১৬টি আসন। বামফ্রন্ট পেয়েছিল মোট ২৪টি আসন। সিপিএম তাদের ইশতেহার শুরু করেছে ৩৬ শতাংশ নারী এবং ৩৪ শতাংশ পুরুষের সঠিক পুষ্টি না পাওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। তারা বলছে, শতকরা ৪৮ ভাগ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু সঠিক পুষ্টি পায় না। শতকরা ২৯ ভাগ ছাত্র  প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে স্কুল ছুট আর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্যে স্কুল ছুটের সংখ্যা শতকরা ৪৬ ভাগ।

সিপিএম তাদের ইশতেহারে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে নব্য উদারনৈতিক নীতি বলে দাবী করে কড়া সমালোচনা করেছে। তারা তাদের ইশতেহারে জানিয়েছে ১৯৯৬ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ ভারতে ২ লক্ষ ৯০ হাজার কৃষক মারা গেছেন।

সিপিএম জানিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা ন্যুনতম মজুরি পায়না। ভাগ চাষি বা কৃষির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের কোন ন্যুনতম মজুরির মাপকাঠি নেই।

সিপিএম অভিযোগ করেছে বিগত ১০ বছরে জ্বালানী তেলের দাম প্রায় তিন গুন বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। ইশতেহারে আরও জানানো হয়েছে ২০০৩ সালে ভারতে মোট ১৩ জন বিলিয়নর থাকলেও ২০১২ সালে তাদের সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে ১২২ জনে। সিপিএম সরাসরি অভিযোগ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের নব্য উদারনৈতিক নীতির ফলে সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে সম্পদশালী শ্রেণির কোষাগারে।

তারা বিরোধিতা করেছে ব্যাপক হারে বেসরকারি করণেরও।

খাদ্য শস্যে ৭৮০০ কোটি রুপি ভর্তুকি কমিয়ে দেবার তথ্য প্রকাশ করে ইশতেহারে তার বিরোধিতা করা হয়েছে।

প্রতি পরিবার পিছু অন্তত ২ রুপি দরে ৩৫ কেজি চাল এবং একই দামে ৭ কেজি করে দানা শস্য দেবার কথা বলা হয়েছে।

দুর্নীতি একটি প্রকাণ্ড সমস্যা বলে দাবী করে দুর্নীতি দমনে কড়া আইনের ব্যবস্থার কথা ইশতেহারে জানিয়েছে সিপিএম। আদিবাসী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সংরক্ষণ শুধু সরকারি ক্ষেত্রেই নয় সিপিএম বেসরকারি ক্ষেত্রেও এই অনগ্রসর শ্রেণির সর্বক্ষণ দাবী করেছে। মুসলিমদের কাজের ক্ষেত্রে ১০% সংরক্ষণের রঙ্গনাথ কমিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে সিপিএম।
 
বিকল্প নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিপিএম তাদের ইশতেহারে জমির পুনর্বিন্যাস, কৃষকদের সঠিক মূল্য প্রদান, অর্থনীতিকে কর্ম সংস্থান মুখি করে তুলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়ে উল্লেখ করেছে। জোর দেওয়া হয়েছে সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার ওপর।  

জঙ্গিবাদ শক্ত হাতে দমন করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে জঙ্গিবাদ দমন করতে গিয়ে যেন বিশেষ কোন একটি ধর্মালম্বি মানুষদের হেনস্তা হতে না হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রসঙ্গে ইশতেহারে সরাসরি বিজেপিকে “ভয়ঙ্কর” আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে মজবুত করতে এবং কুসংস্কার মুক্ত ভারত গড়তে বিদ্যালয়স্তর থেকেই পরিকল্পনা নেবার কথা বলা হয়েছে।

‘আন ল ফুল অ্যাকটিভিটিস (প্রোটেকশন) আইন’ নিয়ে ভারতে বেশ কিছু বিতর্ক আছে। সিপিএম সরাসরি এই আইনকে তুলে দেবার দাবী জানিয়েছে।

প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দরকার মত ভারতের সংবিধান সংশোধনের কথা এই ইশতেহারে বলা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে শ্রমিকদের সামাজিক এবং অর্থনীতিক সুরক্ষা, জাতিগত বৈষম্য দূর করা, দুর্নীতি রোধ এবং স্বাধীন বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করার বিষয়ে।

অর্থনৈতিকে ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তদের কর ছাড় কমানো, ভোগ্য পণ্যের উপর কর বৃদ্ধি করা, গবেষণাধর্মী কাজে ব্যয় বৃদ্ধি করা, বীজ, সার, জ্বালানী তেলের দামে ভর্তুকি, ‘কালোটাকা’ বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়াও খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগ না করা এবং ব্যাংক-বিমা বেসরকারীকরণ এবং খনিজ সম্পদ ও জলসম্পদকে বেসরকারী হাতে তুলে দেবার নীতির বিরুদ্ধে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে রাস্তা, সেতু, গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার উপর।

জোর দেওয়া হয়েছে ক্ষুধা মুক্ত ভারত গড়ে তোলার ওপর। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আইনের পুনর্বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। কড়া সমালোচনা করা হয়েছে বিগত সরকারের আমলে মূল্যবৃধির বিষয়টিকে।

‘জাতীয় যুবনীতি-২০১৪’-কে কার্যকর করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে শিশুদের অধিকার এবং শিক্ষার অধিকারের বাস্তবায়নের উপর। বলা হয়েছে জিডিপির শতকরা ২ ভাগ খরচ করতে হবে বিঞ্জান ও প্রযুক্তি খাতে।

৩৫ পৃষ্ঠার ইশতেহারে সরকারের আর্থিক অনুদানে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় তহবিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গুলির নির্বাচনী খরচ পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে ফাসি তুলে দেবার।  

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে সিপিএম দলের ইশতেহারে। সেটি হল সংবিধানের ৩৭৭ ধারার সংশোধন। এই ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামকে বেআইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এই নিয়ে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল ভারতে।  

ইশতেহারে বিদেশ নীতিতে বলা হয়েছে আমেরিকামুখী বিদেশ নীতি বাতিল করা। ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক না তৈরি করার জন্য আমেরিকামুখী বিদেশ নীতিকেই দায়ী করা হয়েছে। ইশতেহারে পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে এর ফলেই ইরান, পাকিস্তান, ভারত গ্যাস পাইপ লাইন এখনও হয়নি। ক্ষমতায় গেলে তারা তা করবেন।

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আমেরিকার সম্মিলিত সংগঠন ‘ব্রিকিস’ কে আরও গুরুত্ব দেবার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মিলিত সংগঠন “আই বি এস এ”–কে আরও কার্যকরী করার কথা বলা হয়েছে।

জোর দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করার বিষয়টিকে। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে ইশতেহারে আনা হয়েছে। এসেছে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার বিষয়টিও।

এখন শুধু এটাই দেখার বিষয় যে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে কতটা মন গলে ভারতের জনগণের আর তারা তাদের সরকার বেছে নিতে কতটা ইশতেহার কেন্দ্রীক নজর দেন। এর চূড়ান্ত উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৬ মে নাগাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।