ছবি: লেখক
কাশ্মীরি শাল হামদা নরম, গায়ে দিলে গরম। অভিজাত বস্ত্র।
শীতার্তের বাঁচার অস্ত্র। পাড়ে চিরনি কাজ। জমিতে জমাট মন্তাজ। শিল্প নৈপুণ্যে নয়নাভিরাম। কুটির শিল্পকলা। চাষা ঘরে বসে দিনরাত হাতচলা। আঙুলে শুধু সুঁচ আর সূতো। ভূস্বর্গে রূপের প্রলয়। বিশ্ববলয়ে এসে জায়গা আর নেই। তারা পারে, আর কেউ পারে না। কলকাতার নরম কাশ্মীরি শালের চলা। সেটা সৎস্রষ্টার বিরুদ্ধে নিয়ম ঠাট্টা। কাশ্মীরের পরিচয়ে গাঁথা আরও দুটি ফল, আপেল, আখরোট। নদী, পাহাড়, হ্রদে ঘেরা অসীম রাজ্যে আছে রক্তের চিহ্নতানিত্য নতুন সংঘাতের মেঘর আনাগোনা। জঙ্গী হানা রুখতে ফৌজি তৎপরতা। কাশ্মীর কার, উত্তর চাইছে দ্বন্দ্ব বিদীর্ণ জনতা। এবারও জম্মু-কাশ্মীরের ছ’টি লোকসভা আসনে ভোট হয়েছে। তিনটি পেয়েছে বিজেপি, বাকি তিনটি পিডিপির। ভোটের নিরিখে ধরলে রাজ্যটির অর্ধেক বিজেপির, বাকি অর্ধেক পিডিবির। তা তো নয়। নির্বাচিত ছ’জন রাজ্যের প্রায় ৭০ লাখ মানুষের ভার বইতে পারেন কখনও। তাঁরা তাদের হয়ে দিল্লির সংসদে দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারেন, প্রতিবাদ জানাতেও অসুবিধে নেই। তাই বলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি বলেন রাজ্যটা আমাদের, তা কী করে হয়। জম্মু-কাশ্মীর থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি জিতেন্দ্র সিং জিতেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী। এটা তাঁর সৌভাগ্য। প্রথমবার জিতেই মন্ত্রী হওয়াটা সবার কপালে জোটে না। ক্ষমতাটা হজম করতে তার কষ্ট হচ্ছে। তিনি মনে করতে শুরু করেছেন, কাশ্মীর তাঁর একার। মন্ত্রী হয়েই কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের আর্জি জানিয়েছেন। এই ধারায় কাশ্মীরিরা বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। সেটা নতুন বিষয় নয়। কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তির পর থেকেই পেয়ে আসছে। তারমধ্যে প্রধান হচ্ছে সুশাসনের অধিকার। অন্য রাজ্যগুলোর জন্য সংবিধানে যে ২৩৮ ধারা আছে, জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। সেই কারণে বাকি রাজ্যের মতো এ-রাজ্যটিকে ভাঙাচোরা যাবে না। পুনর্গঠনও সম্ভব নয়।
৩৭০ ধারার ভাবনা আসে কাশ্মীরের অধিকার নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার দু’মাস পর অক্টোবরেই পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করে। কাশ্মীর এখনও ভারতের নয়। কাশ্মীরের মহারাজ হরি সিং ভারতের সাহায্য চান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী হরি সিংয়ের পাশে দাঁড়ায়। হরি সিং কাশ্মীরের ভারত অন্তর্ভুক্তিতে রাজি হন। যুদ্ধে জিতেও নেহেরু কাশ্মীরের একটা অংশ পাকিস্তানকে ছেড়ে দেন। এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। নেহেরু কাশ্মীরের ভাগ দিয়ে পাকিস্তানকে শান্ত রাখতে চেয়েছিলেন। যে অঞ্চলটা পাকিস্তানকে ছাড়া হয়, সেটা অত্যান্ত উগ্র এবং দুর্গম এলাকা। সেটাকে সামলানো কঠিন বলে মনে করেছিলেন নেহেরু। আজ সেই এলাকাই পাকিস্তানের অন্যতম জঙ্গী ঘাঁটি।
কাশ্মীরে নজর পড়ে চীনেরও। ১৯৬২-র ১৯ সেপ্টেম্বর, উত্তর সীমান্তে ভারত-চীন সংঘর্ষের অন্যতম কারণ সেটাই। এখনও অনেকটা এলাকা চীনের দখলে। অরুণাচলেও থাবা বসাতে চাইছে চীন। পাকিস্তানের করুণায় কাশ্মীরদেরও একটা ভাগ পেয়েছে চীন। চীন ৩৭,৫৫৫ বর্গকিলোমিটার নিজেই দখল করেছিল। অন্যায়ভাবে পাকিস্তান তাদের দিয়েছে ৫,১১৪ বর্গকিলোমিটার। পাকিস্তানের দখলে ৭৮,১১৪ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের রাজ্য জম্মু-কাম্মীরের আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গ কিলোমিটার। পাকিস্তান-চীনা রাজ্যটিকে কেড়ে নিতে চাইছে।
কাশ্মীরে সীমান্ত এলাকা লাদাখ ছিল চীনের টার্গেট। ১৯৯৭-এর ৪ অক্টোবর লাদাখে স্বশাসিত পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদ বিনা অনুমোদিত হওয়ার পর এলাকাটা শান্ত। এখনও ভারতীয় সিনেমার নিয়মিত শ্যুটিং হয় সেখানে।
১৯৭১-এ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ফের ভারত আক্রমণ করলেও ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তিতে বিষয়টি মীমাংসা হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা বদলে যায়। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ের পর কাশ্মীর আপাতত শান্ত। পর্যটন শিল্পের উন্নতি হয়েছে। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ দিল্লির সঙ্গে গভীরভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ওমরের তিন পুরুষ কাশ্মীরের দায়িত্বে। শেখ আবদুল্লাহ, ফারুক আবদুল্লাহর পর ওমর। শেখ ছিলেন নেহেরুর ঘনিষ্ঠ।
জম্মু-কাশ্মীরের আইনসভায় দিল্লির সংসদের মতোই দু’পক্ষের বিধানসভার আসন ১০০। তারমধ্যে ২৪টি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। ৩৭০ ধারা বদলাতে হলে যৌথ অধিবেশন দরকার। সঙ্ঘ পরিষদ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে। যাতে সাম্প্রদায়িকতা মাথা তুলে। আবার দু’টি দেশ যুযুদ্ধান হয়ে ওঠে। ধর্মীয় ভাবাবেগে রক্তক্ষয় হয়, সদর্থক রাজনীতি নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ঠিক কাজই করেছেন। তিনি জানেন, খুন আর উন্নয়ন একসঙ্গে চলে না। ২৬ মে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দিল্লি সফর খুবই অর্থবহ। মোদি-শরীফ বৈঠককে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। দু’দেশই অর্থনীতিক ডানায় ভর দিয়ে দ্বিপাক্ষিক শিল্প-বাণিজ্যের বিস্তার চাইছে। আলোচনায় শরীফ কাশ্মীরের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তিনি চাননি কাশ্মীর কন্টকে ক্ষতবিক্ষত হোক দ্বিপাক্ষিক সৌহার্দ্য সফর।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, জুন ০১, ২০১৪
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।