ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

সেই গানের ইতিহাস

শোনো, একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের...

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫
শোনো, একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: ‘শোনো, একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী, বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। ’ গানটি সবারই শোনা।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় এবং অংশুমান রায়ের সুরে ও গায়কিতে এ গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই বাংলার মানুষের মনে সাহস যুগিয়েছিল। বলা হয়- মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনে এক দারুণ অনুপ্রেরণার উৎস ছিল গানটি।

এ গানের পেছনের ইতিহাস খুঁজতে নেমেছিল বাংলানিউজ। জানার চেষ্টা করা হয়েছিল কোন পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গানটি হয়ে উঠেছিল। গানটি বেতারে প্রচারের প্রথম দিন এবং তার আগে-পরে ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল।

এসব তথ্য জানিয়েছেন গানটির সুরকার ও গায়ক প্রয়াত অংশুমান রায়ের ছেলে সংগীতশিল্পী ভাস্কর রায় এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’প্রাপ্ত আকাশবাণী কলকাতার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপেন তরফদার।

ভাস্কর রায় বাংলানিউজকে বলেন, ‘দিনটি ছিল ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তখন আন্দোলনে উত্তাল। দুই বাংলার শিল্পীরা প্রায়ই মিলিত হচ্ছিলেন আড্ডায়। এসব আড্ডায় আলোচনার মূল বিষয় ছিল একটাই- মুক্তিযুদ্ধ। ১৩ এপ্রিলের আড্ডায় হাজির ছিলেন গীতিকার গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, অংশুমান রায়, দীনেন্দ্র চৌধুরী, উপেন তরফদারসহ আরও অনেকে। সেখানে টেপ রেকর্ডারে শোনা হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ভাষণের সঙ্গে ভেসে আসছিল জনতার সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। সেই সময়ই গানটি লিখে ফেলেন গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। গানটি রচনা করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে সুর দিলেন বাবা (অংশুমান রায়)। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে সেই গান বাজানো হলো আকাশবাণী কলকাতায় সেদিন রাতে প্রচারিত ‘সংবাদ বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানে। ’

গানটি প্রচারের পর শ্রোতাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পরের দিন চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেলো। যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার মুখে মুখে তখন এই গান। আর এর মাধ্যমে বাবার (অংশুমান রায়) গাওয়া ও সুর দেওয়া গানটি ইতিহাসে জায়গা করে নিলো। ’

বঙ্গবন্ধু এই গান শুনে কী বলেছিলেন- জানতে চাইলে ভাস্কর রায় বলেন, ‘১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিজে গানটির জন্য বাবাকে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ড মেডেল’ দেওয়ার ঘোষণা দেন। বাবার কাছে আমন্ত্রণপত্র আসে। কিন্তু এর মধ্যেই আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। এরপর বাবার আর বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি। এর অনেক বছর পর ২০১২ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকার গানটির জন্য বাবাকে ‘মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা’ এবং ‘মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান’ প্রদান করেন। ’
Kolkata_02
গানটি হয়ে ওঠার সেই ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী উপেন তরফদার বললেন, ‘আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন ফোনে জানিয়েছিলেন, তার বাড়িতে বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান এসেছেন। খবরটি পেয়েই টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছুটলাম পূর্ণদাস রোডে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। গিয়ে দেখি সেখানে আছেন- গৌরি দা (গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার), লোকসংগীত  শিল্পী দীনেন্দ্র চৌধুরী এবং অংশুমান রায়। কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। এরপর কামরুল হাসানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর বের হবো বলে ঠিক করেছি। এমন সময় অংশুমান রায় কামরুল হাসানকে বাংলাদেশ নিয়ে গৌরি দার লেখা একটা গান শোনাতে চাইলেন। কিন্তু গান গাওয়ার জন্য হারমোনিয়াম-তবলা নেই। সেই বাড়ির নিচ তলায় থাকতেন রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ঘর থেকে হারমোনিয়াম আনা হলো। কিন্তু তবলা? একটা বাঁধানো মোটা খাতার উপর আঙুল ঠুকে দিব্যি সেটাকে তবলা বানিয়ে ফেললেন দীনেন্দ্র চৌধুরী। গান গাওয়া হলো। রেকর্ডও করা হলো। ’

স্মৃতির অতল থেকে তিনি বলতে থাকলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের কিছু অংশের সঙ্গে গানটি বাজানো হলো। তারপর থেকে যে উৎসাহ, আবেগ তৈরি হলো সেটা ইতিহাস। মনে রাখবেন এই গান যখন রেকর্ড আকারে বাজারে বের হলো তখনও আগে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ বাজত তারপর শুরু হতো মূল গান। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৫
ভিএস/আরএম

** ‘সেদিন ছিল আমাদেরও বিজয়ের দিন’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।