ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

ব্রিটিশ বধের ১০০ বছর

রক্তিম দাশ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১১
ব্রিটিশ বধের ১০০ বছর

কলকাতা: আজ শুক্রবার। ইতিহাসের এই দিনটির দিকে তাকালে ১৯১১ সালের শিল্ড বিজয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

খালি পায়ে ফুটবল খেলা এগারো বীর বাঙালির ব্রিটিশ সাহেবদের বিরুদ্ধে বিজয়গাঁথা, যা ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে।

বাংলার সমাজিক জীবনে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের গুরুত্ব ও প্রভাব বিশাল। দু’টি ক্লাব নিয়ে একাধিক ছবি হয়েছে। যদিও তা ইতিহাসধর্মী নয়। নিছক ব্যবসায়িক খাতিরে বাংলা ছবি। সেই ছবি দেখতে মানুষ উপচে পড়েছিল।

মনের আনন্দে তারা সিনেমা হলে গিয়েছিলেন, এখানেই শেষ নয়, ইস্টবেঙ্গল জিতলে পরের দিন বাজারে বাঙালদের ইলিশ মাছ কেনার ধুম। সেই ইলিশ মাছ আবার মোহনবাগান ঘটি সমর্থকদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার রেওয়াজ এখন অতীত।

মোহনবাগান জিতলে চিংড়ি খাওয়ার রেওয়াজ বহুদিনের। দুই প্রধানের কট্টর সদস্যদের এখন অনেকেই বড় ম্যাচের খোঁজ রাখেন না। মাঠে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তো দূরের কথা। খুব উৎসাহী হলে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে জেনে নেন খেলার ফলাফল। আরও উৎসাহী হলে সংবাদপত্র দপ্তরে টেলিফোন করে জেনে নেন, ব্যস ওইটকুই।

নেই নেই করে এখনও দুই প্রধানের সমর্থকের সংখ্যা কম নয়। জনবহুল এই রাজ্যে ফুটবল উদ্দীপনার সঙ্গে সঙ্গে দুই ক্লাবের সমর্থকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দুই প্রধানের খেলা থাকলে মাঠে যান কমপক্ষে ষাট হাজার মানুষ। তাঁরা কারা? অন্ধ ক্লাব ভক্ত, বেকার যুবক, পাড়ায় ক্রীড়া সংগঠক।

কিন্তু বাবা ছেলেকে নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন, এ দৃশ্য চোখে পড়বে? মাঠ-ময়দানের পরিবেশ এখন ভালো নয়, মাঠে গেলেই ওই সন্তান কিছু বিশ্রী শব্দ শিখে আসবে। মেয়েরা মাঠে যেতে পারেন না, সুষ্ঠু পরিকাঠামোর অভাবে। তারপর উগ্র সমর্থকদের চোখ রাঙানি তো আছেই। দুই প্রধানের খেলা দেখতে গিয়ে কলকাতার যুবভারতীতে স্টেডিয়ামে বোমা ফেটে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর কে বুকে বল নিয়ে যুবভারতী যাবেন?

একটা সময় ছিল হাওড়া শহর মানে মোহনবাগান সমর্থকদের ভিড়। সেখানে হাতেগোনা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। কলকাতার বেলেঘাটা আবার ইস্টবেঙ্গলের ঘাঁটি। কালের গতিতে সবই হারিয়ে বসে আছে। ক্লাব কলোনি তাই এখন ইতিহাস। আসলে বাংলার সমাজ জীবনে দুই প্রধানের  যে অবদান ছিল তা এখন আর নেই। আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রছাত্রীরাও মাঠে যেত, এখন সেই রেওয়াজই উধাও। কী কারণ? কে দায়ী?

কলকাতার মাঠে ময়দানে এই প্রশ্ন উঠলেও উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। ‘এই তো বেশ আছি’ গোছের কথাবার্তা কর্তাদের মুখে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে খালি পায়ে এগারো জন ফুটবলারের বীরগাঁথা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেলেও তা নিয়ে চর্চা নেই। হয়তো হাতেগোনা কিছু মানুষ তা নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। জাতীয় গ্রন্থগারে গেলে সামান্য কিছু দলিল দস্তাবেজ পাওয়া যাবে। এর বেশি কিছু নয়।

যে এগোরো জন ফুটবলার ১৯১১ সালে বীরত্বগাঁথা রচনা করেছিলেন, কালের নিয়মে তাঁদের কেউ বেঁচে নেই। বেঁচে নেই তাঁদের অনেকেরই পরের প্রজন্মও। ফলে তৃতীয়  প্রজন্মের পক্ষে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়।

অনেকেই জানেন না সেই ম্যাচ দেখার জন্য হাওড়া স্টেশন থেকে দু’তিনটি স্পেশাল ট্রেন চালানো হয়েছিল। মোহনবাগানের সেই জয়ী দলের এগারো জন ফুটবলার জনতার কাঁধে চড়ে ফিরেছিলেন নিজঘরে। তখনকার কিছু সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় স্থান হয়েছিল ঐতিহাসিক ওই ম্যাচের। ব্রিটিশ ক্লাব ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্ট দলকে হারানোর পর দর্শকদের উচ্ছ্বাস কিছুটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।

শিল্ড জয়ের বহু আগে মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠা। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ক্লাব যে তিমিরে ছিল, রয়েছে কী সেই তিমিরেই? সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘উন্নতি কিছু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু প্রবহমানকালের সঙ্গে তা মানানসই নয়। ফলে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের যুগে যখন আমরা এসে পড়েছি, তখন উন্নতির লেখচিত্র আরও উঁচুতে ওঠা দরকার ছিল। ’

টেলিভিশনের যুগে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের খেলা ঘরে বসে দেখা যায়। দেখা যায় বার্সেলোনার খেলা। দেখা যায় লা লিগা, ইতালিয়ান লিগ, যা দেখা যেত না, সেই ব্রাজিল লিগও টিভির পর্দায়।

রাত জেগে যে খেলা দেখে মন তৃপ্তিতে ভরে যায়। প্রকৃত ফুটবলপ্রেমীর তৃষ্ণা মেটে।

ঠিক এরকমই একজন, অতীতে যিনি ছিলেন মোহনবাগানের কার্যকরী সমিতির সদস্য। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি মোহনবাগান পরিবারের সদস্য। সেই সোমনাথ চ্যাটার্জি একসময় বলতে পারতেন মোহনবাগানের এগারো জন ফুটবলারের কথা। বলতে পারতেন অতীতের মোহনবাগান নিয়ে হাজার হাজার শব্দ।

কিন্তু তিনি এখন মোহনবাগান নিয়ে দুটো শব্দ খরচ করতে পারেন না। শুধু বলতে পারেন মোহনবাগানের ঘরে ট্রফি কোথায়? বিদায়ী মৌসুমে একটিও ট্রফি পায়নি। লোকসভার সাবেক স্পিকার এখন রাত জেগে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখেন।

তার কথায়, ‘জানেন, একসময় মোহনবাগান নিয়ে স্ত্রী’র সঙ্গে ঝগড়া হতো, এখন ঝগড়া হয় রাত জেগে বিদেশি ফুটবল দেখি বলে। ’

মোহনবাগানের খেলা দেখেন না কেন? ‘ভালো লাগে না। খেলার সেই গতি নেই। শারীরিক সক্ষমতা নেই। আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। বিদেশি ফুটবলার খেলিয়ে মোহনবাগান কর্তারা অতীতের ঐতিহ্য ভেঙেছেন ঠিকই। উন্নতি করতে পারলে কিছু বলার ছিল না, কিন্তু সেই উন্নতি কোথায়। ’

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এখন আর মোহনবাগানের কথা মনে রাখেন না। মোহনবাগানের খেলা থাকলে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন না। নিজেকে ‘পুরানোপন্থী’ বলে অভিমান গোপন করেন। বয়স হলেও মোহনবাগানের স্মৃতি ধূসর হয়ে যায়নি তাঁর হৃদয়ে। মোহনবাগান তাঁর হৃদয়ের একটি অংশ। যৌবনে প্রিয় দলের খেলা দেখতে হাইকোর্টের কাজ ফেলে মাঠে ছুটে যেতেন। সেই মানুষের কাছে মোহনবাগান আজ ব্রাত্য। কে কাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে প্রশ্ন সেখানেই।

কলেজ জীবনে কলকাতায় পড়তে এসে ময়দানের সঙ্গে পরিচিত হন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রেমেও পড়ে যান। কিন্তু তারপর থেকেই ফুটবলকে দূরে রাখতে পারেননি। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা ফুটবলকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল এখন তাঁকে টানে না। তাঁদের নিয়ে কিছু সাহিত্য লেখার ইচ্ছে জাগে না। নাতি অথবা নাতনিকে নিয়ে কলকাতা মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে না? প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠেছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘না বাবা, কলকাতা মাঠে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। ’

ছাত্রজীবনে কলেজ পালিয়ে সিনেমায় দেখার যুগ একেবারেই অধুনা। কিন্তু আটের দশক পর্যন্ত কলেজছাত্ররা হতেন মাঠমুখী। জমিয়ে খেলা দেখতেন বড় দলের। হাতে পায়ে কাদা ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করতেন ক্লাবের ট্যাপ কলে। তারপর জমিয়ে পাউরুটি সঙ্গে আলুরদম খেয়ে সোজা বাড়ির পথে পা দিতেন।

একান্নবর্তী সংসারে সকালের খেলার পাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো। সেই দিনও গেছে, সময়ও গেছে।

মোহনবাগান ক্লাবের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড নিয়ে ‘এগারো’ সিনেমার প্রয়োজক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের বলেন, ‘এই সিনেমা করতে গিয়ে বুঝেছি ইতিহাস কী বিশাল। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামের ফাঁসি, তার আগে বঙ্গভঙ্গ। কলকাতা থেকে রাজধানী সরিয়ে দিল্লি নিয়ে যাওয়া ব্রিটিশদের যাবতীয় কুর্কমের জবাব ছিল মোহনবাগানের শিল্ড জয়। ’

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া গেছে ব্রিটিশদের হারানো যায়। অদম্য মনোবল থাকলেই তা সম্ভব।

অনিলাভের দাবি, ‘ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে দু-লাইন না দিয়ে আলাদা পরিচ্ছদ হোক। ’ কে তুলবে এই দাবি? এই প্রশ্নটাই আজকের সমাজে মিলিয়ন ডলারের। সেদিন জনসমর্থনের চাপে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা স্পেশাল ট্রেন চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, অগনিত স্টিমার গঙ্গা পারাপার করেছিল।

রসিকরা বলে থাকেন, হেরে যাওয়ার ভয় থাকলে হয়তো স্পেশাল ট্রেন অথবা স্টিমার চালাতেন না ব্রিটিশ শাসকরা। ইতিহাস ঘেঁটে ছবি তৈরি করতে গিয়ে যে তথ্য হাতে পেয়েছিলেন তাতে শিহরিত অনিলাভ।

মোহনবাগানের যা ইতিহাস তা দিয়ে মিউজিয়াম বানানো যায়। সেই মিউজিয়ামে স্থান পেতো এগারো জন যোদ্ধার বীরত্বগাঁথা, সেই গাঁথার মধ্যে দিয়ে মানব ইতিহাসে বেঁচে থাকতো মোহনবাগান। মোহনবাগানে এখন অতীত রয়েছে, বর্তমান ধূসর। ইস্টবেঙ্গলকেও একই গোত্রে ফেলা যায়। ক্লাব কর্তারা গৌরবের সঙ্গে অতীতের কথা বলে থাকেন। ‘জানেন, আমাদের ক্লাবে অমুক অমুক ঘটেছিল...’।

কিন্তু বতর্মানে কী ঘটছে, ফুটবল সমর্থকদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেবে কে? সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গির বড় অভাব। অভাব নতুন কিছু করার। গয়ংগচ্ছ ভাব সর্বত্র। শুধু ফুটবল দল গড়ে কিছু ম্যাচ, কিছু ট্রফি জয়ের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন ক্লাব কর্তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।