ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

জ্যোতি বসু নগরীর নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বুদ্ধিজীবীদের ক্ষোভ

রক্তিম দাশ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১১
জ্যোতি বসু নগরীর নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বুদ্ধিজীবীদের ক্ষোভ

কলকাতা: ভারতের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘদিনের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর নামে নগরীর নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার।

তবে বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

এরই মধ্যে বামদলগুলোসহ রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা সরকারের এ মনোভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

নিউটাউনের নাম ‘জ্যোতি বসু নগর’-ই রাখতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু।

বহরমপুরে বুধবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিউটাউনের নাম  জ্যোতি বসু নগর রাখার প্রস্তাব বিধানসভায় গৃহীত হয়েছিলো বামফ্রন্ট সরকারের সময়। এখন নতুন সরকার এসে  সেই নাম পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে মিডিয়ার খবরে দেখছি। আমরা এ বিষয়ে বামফ্রন্টের বৈঠক  ডেকে আলোচনা করবো। বামফ্রন্টের কোনও শরিক দলই  জ্যোতি বসু নগর নাম বাতিল করার উদ্যোগ সমর্থন করবেন না। অবশ্যই বিরোধিতা করবেন। ’

বিমান বসু বলেন, ‘এ দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে, গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তিত্বের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। জনগণই জ্যোতি বসুকে এভাবে মুছে ফেলার অপচেষ্টার বিরোধিতা করবে। ’

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এদিনই কলকাতায় বিধানসভার প্রেস কর্নারে সংবাদ সম্মেলনে নিউটাউনের ‘জ্যোতি বসু নগর’ নাম বাতিলের উদ্যোগ নেওয়ায় রাজ্যের তৃণমূলী জোট সরকারকে রাজনৈতিক অসৌজন্যের দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সৌজন্যবোধের অভাব থেকেই এমন আচরণ করছে রাজ্য সরকার। প্রবীণ বামফ্রন্ট নেতা অশোক ঘোষ ইতোমধ্যেই এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমরাও বিধানসভায় বিরোধী দলের পক্ষ বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য বলেছি। ’

বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন বলেন, ‘রাজারহাট এলাকায় গড়ে ওঠা নতুন স্যাটেলাইট শহরের নামকরণ জ্যোতি বসু নগর হওয়াটাই যথার্থ। এক্ষেত্রে কোনও অন্যায় করেনি পূর্বতন রাজ্য সরকার। সারা দেশের কাছে শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক জ্যোতি বসু নিজে এই শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সর্বপ্রকার সহায়তা দিয়েছেন। তার স্বপ্ন ছিল আমাদের রাজ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি শহর গড়ে উঠুক। নতুন প্রজন্মের চাহিদা মেটাতেই এ নগর তৈরির পরিকল্পনা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন কেনই বা তার পরিবর্তন হবে?’

চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদার বলেন,‘ রাজারহাট নিউ টাউনের নামকরণ জ্যোতি বসু নগর করার মধ্যে অসঙ্গতিটা কোথায়? কেনই বা সেই নামকরণ পালটানোর কথা হচ্ছে? এটা কোন ধরনের রুচি? সবটাই খুবই দুর্ভাগ্যজনক হয়ে উঠছে। তাহলে তো বিধাননগরের নামও পালটাতে হয়। সেটা কি কোনও যুক্তিতে সমীচীন হবে? কোনও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ বিষয়টি দেখা উচিত নয় কখনই। রুচিহীন এই বিতর্ক নিয়ে কোনও মন্তব্য করতেই ইচ্ছে হয় না। ’

প্রবীণ নাট্য পরিচালক শোভা সেন বলেছেন,‘জ্যোতি বসু নগরের নাম আর পরিবর্তন করা যাবে না। তা করা হলে মহান মানুষ প্রয়াত জ্যোতি বসুর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নজিরবিহীন ইতিহাস তৈরি হবে। যা কখনই রাজ্যবাসী চান না। এটা করার অর্থ হলো, এক ধরনের সঙ্কীর্ণ গোঁড়ামি। যা এ রাজ্যের রুচি ও সংস্কৃতির পরিপন্থি। শুধু তাই নয়, এর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তা আরও বাড়বে। ’

বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুনীল গাঙ্গুলী এর প্রতিবাদ করে বলেন,‘ রাজ্যে প্রায় আড়াই দশক একটানা মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। সারা দেশ, বিদেশের সবাই তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই চেনেন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্যের একটা নতুন শহরের নামকরণ তাঁর নামে হওয়ায় কার কোন অসুবিধাটা হচ্ছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এই নামকরণে কী এমন অন্যায় হয়েছে যে, তা আবার বদলে দিতে হবে?’

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ বলেন,‘রাজ্যে এই মুহূর্তে অনেক সমস্যা রয়েছে। সেই সমস্যাগুলোর সমাধানে নতুন রাজ্য সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। রাজারহাট নিউ টাউনের নামকরণ জ্যোতি বসু নগর হয়ে  গেছে। যখন এ ঘোষণা হয়, তখন কেউই কোনও আপত্তি তোলেননি। এখন এই নিয়ে বাজারি গোলযোগ করা ঠিক নয়। তাছাড়া নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সব কিছুর নাম বদল করাটা সরকারের একমাত্র কাজ হতে পারে না। ’

তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন,‘ এই সরকারের কোনও কাজেরই কোনও তাল লয় পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, জঙ্গলমহলের সমস্যাটা না বুঝে মুখ্যমন্ত্রী ওখানে যেভাবে আঙুল নাচিয়ে কথা বলে চলেছেন, তাতে ওই এলাকার আদিবাসী কোনও মানুষেরই ভালো কিছু হওয়ার নয়। আসলে এসবই হচ্ছে মাওবাদীদের আড়াল করতে সেই মাওবাদীদেরই কপট শাসনের ভঙ্গিমা। ’

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও নকশাল নেতা আজিজুল হক বলেন,‘তথাকথিত পরিবর্তনপন্থি রাজ্য সরকার কোন পরিবর্তনটা চাইছে তা তার কাজকর্মেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। জ্যোতি বসু নগরের নাম পরিবর্তনের কথা বলার মধ্যেই ওদের নীচ রুচির প্রতিফলন হচ্ছে। এটা ওদের রাজনৈতিক ‘ইতরতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদের এই সঙ্কীর্ণতা দিয়ে ওরা কখনই জ্যোতি বসুর মতো বড় রাজনীতিকের অশ্রদ্ধা করতে পারবে না। রাজ্যবাসী তা মানবেন না। ’

চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর বলেছেন,‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তথা রাজ্য সরকার তাদের রাজ্যের একটি শহরের নামকরণ করেছে প্রয়াত জ্যোতিবাবুর নামে, এতে অন্যায়টা কোথায় ? সারা বিশ্বে জ্যোতিবাবুই একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, যাঁকে সকলে চেনেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এক গণতান্ত্রিক দেশের কমিউনিস্ট নেতা হিসাবে। সারা বিশ্ব তাকে সম্মান করে। সেটা যাদের সহ্যের নয়, প্রয়োজনে তারা মুখ লুকোক। জ্যোতি বসু সসম্মানেই থাকবেন এই রাজ্য, দেশ ও বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায়। ’

ভারতের সাবেক ক্রিকেট খেলোয়াড় সম্বরণ ব্যানার্জি বলেছেন,‘ এটা অত্যন্ত শিশুসুলভ ব্যাপার। আমাদের রাজ্যের সংস্কৃতির পরিপন্থিও বটে। একটা অঞ্চলের নাম এভাবে হঠাৎ করে বদলে ফেলার কী অর্থ, তা আমার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না রাজ্যপালও বা কী করে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের একজন নাগরিক হিসেবে আমি রাজ্য সরকারের এই মানসিকতাকে কখনোই সমর্থন করি না। আমার বিশ্বাস, আমাদের রাজ্যের সুবিবেচক কোনও মানুষই একে সমর্থন করবে না। ’

ভারতের সাবেক ফুটবল অধিনায়ক ও অলিম্পিয়ান চুনী গোস্বামী বলেছেন,‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবুর অবদান অনস্বীকার্য। তাই তার নামাঙ্কিত একটি অঞ্চলের নাম আকস্মিকভাবে বদলানোর সিদ্ধান্তে আমি বিস্মিত। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, জ্যোতি বসুর মতো মহান ব্যক্তিত্বের নাম নিয়ে রাজনীতি করা কোনওভাবেই উচিত নয়। কারণ দলমত নির্বিশেষে জ্যোতিবাবু ছিলেন অনন্য। সেজন্য তার নাম নিয়ে রাজনীতি মেনে নিতে পারছি না। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।