কলকাতা: ভারতে এক লাফে অনেকটা চড়ে গেল খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার। উৎসবের মৌসুমে প্রতিদিন বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষ যা টের পাচ্ছেন তার আংশিক প্রতিফলন পড়েছে পাইকারি মূল্যে।
বৃহস্পতিবার সরকারি হিসেবে জানানো হয়েছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার পৌঁছেছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশে। ১৫ অক্টোবর শেষ হওয়া সপ্তাহে খাদ্যমূল্য ছিল গত ৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। তার আগের সপ্তাহে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ।
উৎসবের মৌসুম চলছে, বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে আরও চড়া হারে। এই পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে কাঁচা সবজির। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় আনাজের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ফলের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, দুধের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশ, মাছ-মাংস-ডিম ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ, ডালের দামও বেড়েছে ৯ দশমিক ০৬ শতাংশ, দানাশস্যের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
অগ্নিমূল্যে একমাত্র স্বস্তি পেঁয়াজের দাম বেশ খানিকটা কমেছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজের দাম কমেছে ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
যৎসামান্য কমেছে গম ও আলুর দামও। তবে এই দুই পণ্যেই দাম কমা এতোই সামান্য যে তা বাজারে প্রতিফলিত হবার মতো নয়। সব মিলিয়ে প্রাথমিক পণ্যের ক্ষেত্রে ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির হার।
ভারতের কেন্দ্রিয় রিজার্ভ ব্যাংক তিনদিন আগেই তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, মূল্যবৃদ্ধি হ্রাসের কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবে কেন্দ্রীয় সরকার ও রিজার্ভ ব্যাংক আগামী বছরের মার্চে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধি কমতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছে। এমন আশার কথা গত ছ’বছর ধরেই শোনানো হচ্ছে।
ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হার বিশ্বের পায় সব দেশের থেকে বেশি। আগস্ট মাসের হিসেব (সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ধরে) অনুযায়ী ভারতের মূল্যবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ। ভারতের চেয়ে বেশি পাকিস্তান (সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৫), আর্জেন্টিনা (সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৯), ভেনেজুয়েলা (সেপ্টেম্বরে ২৬ দশমিক ৭), ভিয়েতনামে (সেপ্টেম্বরে ২২ দশমিক ৪)। অন্য সব দেশের হার ভারতের থেকে কম।
সঙ্কটে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩.৯), যুক্তরাজ্য (৫.২), স্পেন (৩.১), গ্রিসেও (৩.১) মূল্যবৃদ্ধির হার ভারত থেকে অনেক কম। চীনে এই হার সেপ্টেম্বরে ৬.১। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই আন্তর্জাতিক ভাবে পণ্যের দাম বৃদ্ধির যুক্তি শোনানো হয়। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, শুধু এখনই নয়, গত দু’বছর ধরে লাগাতার ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হার বিশ্বের একেবারে সামনের সারিতে।
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, খাদ্যের দামের বার্ষিক বৃদ্ধির হার জোরগতিতে বাড়ছে। এক বছর আগের দামের সঙ্গে সময়ভিত্তিক তুলনা করে এই হিসেব পাওয়া যায়। সেই হিসেবে, ২০০৪ সালের তুলনায় ২০০৫ সালে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছিল ২.৯৭ শতাংশ।
একই ভাবে, ২০০৫ সালের তুলনায় ২০০৬ সালে বেড়েছিল ৫.০৯ শতাংশ । ২০০৬ সালের তুলনায় ২০০৭ সালে বাড়ে ৫.৬ শতাংশ । ২০০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে বাড়ে ৭.৮৭ শতাংশ । ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে বেড়েছিল ১২.৯ শতাংশ । আর ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ডিসেম্বরে ১০.১ শতাংশ। ২০১১ সালে এখনও পর্যন্ত তা ১১ শতাংশের কিছু বেশি।
খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির পিছনে একটি অন্যতম কারণ দাঁড়িয়েছে সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থার ক্রমশ অবলুপ্তি। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত মানুষের আয়ের বড় অংশই যেমন শুধু খাদ্যের জন্য চলে যাচ্ছে তেমনি খোলা বাজারে দাম বাড়ানোর পক্ষেও তা সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি কারণ হিসেবে কৃষি উৎপাদনের ঘাটতিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
ভারতে খাদ্যশস্য উৎপাদন ২২ কোটি টন থেকে ২৩ কোটি টনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে ভারতে মাথাপিছু খাদ্যশস্যের যোগান বিশ বছর আগের থেকেও এখন কম।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ভারতকে আগামী পাঁচ বছরে খাদশস্য, ডাল, তৈলবীজ, দানাশস্য আমদানির পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে। এমনকি বিশ্বের সামনের সারির দুধ উৎপাদক ভারতকে এবার দুধ আমদানির দিকেও যেতে হবে। আটের দশকে আফ্রিকার পরিস্থিতির সঙ্গে এই চিত্রকে তুলনা করা হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদনের বদ্ধদশা নজর এড়াতে পারে না। অর্থনৈতিক বিকাশের হারের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন বিকাশের হারের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৫০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের বার্ষিক গড় হার ছিল ৪.৪ শতাংশ। তখন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার ছিল ২.৩ শতাংশ।
২০০১ থেকে ২০১০ সালে অর্থনৈতিক বিকাশের গড় হার ৭.২ শতাংশ। অথচ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির গড় হার এই পর্বে মাত্র ২.৪ শতাংশ। কৃষি উৎপাদনে এই মন্থর গতির অন্যতম কারণ, কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ তলানিতে এসে ঠেকেছে।
নবম পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দের ৪.৩৭ শতাংশ ছিল কৃষিতে। দশম পরিকল্পনায় তা কমে দাঁড়ায় ৩.৮৬ শতাংশ। একাদশ পরিকল্পনায় তা আরো কমে দাঁড়ায় ১.৮৩ শতাংশে।
তবে খাদশস্যের মূল্যবৃদ্ধির উৎস শুধু জোগানে নয়। খাদ্যশস্যের বাণিজ্যে এখন বড় ব্যবসায়ীদের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছে। ফাটকা কারবারের আগাম বাণিজ্য কোনোভাবেই জিনিসের দাম কমতে দিচ্ছে না।
কেন্দ্রের তরফে এবারও ভালো বর্ষার কথা জানানো হয়েছে। কিন্তু বর্ষার ফসল উঠলেও দাম কমার কোনও সম্ভাবনা নেই এবং তা গত কয়েক বছর ধরেই প্রমাণিত।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সি পি চন্দ্রশেখর এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, সরবরাহ বাড়াবো বলে সরকারি ঘোষণা আর রিজার্ভ ব্যাংকের সুদের হার কমানো-বাড়ানো ছাড়া জিনিসের দাম কমাতে কোনো হস্তক্ষেপ নেই। এর একটি বড় কারণ হলো আসলে দাম বাড়ছে নয়া উদারনীতির ফলাফল হিসেবে। নিয়ন্ত্রণের কোনও ক্ষমতাই আর নেই সরকারের। তাহলে নীতি বদল করতে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১১