কলকাতা: দুনিয়াজুড়ে মানুষ যখন নয়া-উদারবাদকে বাতিল করতে চাইছেন, তখন সেই নীতিকেই আঁকড়ে ধরছেন ভারতের শাসকরা। এই নীতির ফলে গত দুই দশকে ভারতে যেমন বিলিওনিয়ার বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে শোষণের হারও।
এদিন বিধাননগরে উন্নয়ন ভবনের প্রেক্ষাগৃহে সিপিআই (এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির উদ্যোগে ‘সাম্প্রতিক সময়ের চ্যালেঞ্জ ও বামপন্থীদের সামনে কর্তব্য’ বিষয়ে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন কারাত।
প্রকাশ কারাত নয়া-উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র মানুষের বিক্ষোভের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দু’দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর উল্লাসের সঙ্গে বলা হচ্ছিলো যে, একমাত্র পুঁজিবাদই মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ। আজ আমেরিকাসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে সেই উচ্ছ্বাস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মানুষ পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আজ প্রশ্ন তুলছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কার্ল মার্কস পুঁজিবাদ সম্পর্কে যা বলে গিয়েছিলেন, আজ তা বাস্তবে দেখছেন মানুষ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভয়াবহ সঙ্কট, অর্থনৈতিক মন্দা, পরিসেবাখাতে সরকারি ব্যয় সঙ্কোচন ইত্যাদি ঘটনা ঘটছে প্রতিটি দেশে।
প্রকাশ কারাত বলেন, লগ্নিপুঁজি পরিচালিত বিশ্বায়নের নীতি অনুসরণকারী দেশগুলো ২০০৭ সাল থেকেই তীব্র সঙ্কটে পড়েছে। মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন, মজুরি কমছে, জনকল্যাণকর খাতে ব্যয় কমছে। স্পেন, গ্রিসসহ ইউরোপের দেশে দেশে ছাত্র-যুবরা পথে নামছেন। এমনকি আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে বামপন্থী আন্দোলন দুর্বল, সেখানেও ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন তীব্র আকার নিয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতের পরিস্থিতি উল্লেখ করে প্রকাশ কারাত বলেন, নয়া-উদারবাদী নীতি নিয়ে চললেও বিশ্বজুড়ে এই সঙ্কটের প্রভাব ভারতে তেমন একটা পড়লো না কেন? কারণ, বিশেষ করে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে বামপন্থীদের প্রতিরোধের ফলেই ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করতে পারেনি। বামপন্থীরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলেই বিদেশী ব্যাংকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার কিনতে পারেনি, বীমাক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো যায়নি। ফলে পেনশন তহবিলের টাকা শেয়ার বাজারের কাছে ছেড়ে দিতে পারেনি প্রথম ইউপিএ সরকার। সে কারণেই আমেরিকা বা ইউরোপের মতো ভারতের কোনো ব্যাংক উঠে যায়নি, সঙ্কটের চাপ এসে পড়েনি।
কারাত বর্তমান সরকারের নীতির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, লগ্নিপুঁজি পরিচালিত বিশ্বায়নের নয়া-উদারবাদী নীতির এই সঙ্কট থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি ভারতের শাসকরা। আজ যখন সারা পৃথিবীতে এই নীতিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করছেন, তখন মনমোহন সিং অ্যান্ড কোম্পানি চাইছেন নয়া-উদারবাদের নীতিকেই কার্যকর করতে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এর পক্ষে সওয়াল করছেন।
গত দুই দশকে এই নীতিকে অনুসরণ করে ভারতের কী হাল হয়েছে, তা তুলে ধরে প্রকাশ কারাত বলেন, এই নীতির ফলে দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজিপতিরাই উপকৃত হয়েছেন। গরিব মানুষের ওপর শোষণের মাত্রা আরো তীব্র হয়েছে। এই সময়ে ভারতের বিলিওনিয়ারের (৫শ’ কোটি রুপির বেশি মালিক) সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে, আটের দশকে যেখানে মূলধনের তুলনায় লাভের অংশ ছিল ২০ শতাংশ, তা নয়ের দশকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশে। আটের দশকে লাভের শতাংশের হার ছিল মজুরির হারের চেয়ে কম। কিন্তু নয়ের দশকে তা অতিক্রম করে যায়। আবার গত এক দশকে লাভের হার দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে।
কারাত বলেন, আসলে শ্রমজীবী মানুষের ওপর শোষণের হার বাড়ছে বলেই মুনাফার হারও ক্রমশ বাড়ছে। এই নীতির ফলে বড়লোক ও গরিবের মধ্যে ব্যবধান আরো বেড়েছে।
নয়া-উদারবাদী নীতির ফলে সবচেয়ে আক্রান্ত অংশের কথা তুলে ধরে প্রকাশ কারাত বলেন, দেশের শ্রমিকদের মধ্যে ৮৬ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। সংগঠিত ক্ষেত্রের মত এদের কোনো চাকরির নিরাপত্তা, আয়ের নিরাপত্তা বা সামাজিক নিরাপত্তা নেই। কোনরকম সামাজিক নিরাপত্তা এরা পান না। নয়া-উদারবাদী নীতির সবচেয়ে নির্মম আক্রমণের শিকার এই অংশের শ্রমজীবীরা। আবার দেশের শ্রমজীবী মানুষের ৫০ শতাংশই কাজ করেন কৃষিক্ষেত্রে। কৃষকদের অবস্থাও খুবই সঙ্কটজনক।
কারাত বলেন, আশার কথা, দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই প্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট ডাকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। কারাত বলেন, বামপন্থীদের দায়িত্ব হলো, নয়া-উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা।
সঙ্কটের বিপদ থাকা সত্ত্বেও কেন ইউপিএ অথবা এনডিএ নেতৃত্ব এই নীতিকেই অাঁকড়ে ধরে থাকছে, তা ব্যাখ্যা করে প্রকাশ কারাত আরো বলেন, কারণ যাদের এরা প্রতিনিধিত্ব করছে, ভারতের সেই বৃহৎ পুঁজিপতিরা এখন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের অন্যতম অঙ্গে পরিণত হয়েছেন। আম্বানি, মিত্তাল, টাটাদের মতো পুঁজিপতিরা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম। এরা চাইছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই ভারতের নীতি পরিচালিত করতে। আর অভ্যন্তরীণ এই নীতির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যাচ্ছে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রেও। সেজন্যই প্রায় ১২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এতোদিন ইরান থেকে আমদানি করা হলেও এখন মার্কিন চাপে তা বন্ধ করে আলাদা পাইপলাইন তৈরি করা হচ্ছে। পরমাণুচুক্তিও এর ফলেই।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেটা অগ্রাধিকার, সেটা ভারতের শাসককুলের কাছে অগ্রাধিকারযোগ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই খুচরো বাণিজ্যে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আনতে এতো তৎপরতা, কারণ হিলারি ক্লিনটন বা বারাক ওবামা যেই ভারতে আসুন তাদের মাথাব্যথা ওয়ালমার্টকে এদেশের বাজারে ঢুকতে দেওয়া নিয়ে। শুধু খুচরো বাজারেই নয়, কৃষি, শিক্ষা, ব্যাংকিং প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই মার্কিন স্বার্থে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আনতে চাইছে সরকার।
কারাত বলেন, ‘২০০৫ সালে আমাদের প্রতিরোধের কারণে খুচরো বাজারে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ হতে পারেনি। মমতা ব্যানার্জি এখন বিরোধিতা করছেন, দেখলাম। ভালো কথা, তবে উনি এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন কেন, সেটা বোঝা গেলো না। ’
প্রকাশ কারাত এই প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকেও আরো তীব্র করার আহ্বান জানান।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচিতিসত্তার আন্দোলন মাথাচাড়া দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে কারাত বলেন, বামপন্থীদের সামনে এটাও একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতি-উপজাতি প্রভৃতি বিভিন্ন ধরণের মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে হাতিয়ার করে সংগঠন, রাজনৈতিক দলের জন্ম হচ্ছে। নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদেশী আর্থিক সাহায্যপুষ্ট হয়ে এই সব আন্দোলনে মদত দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও উত্তর-আধুনিকতার মতবাদের নামে একে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কারাত বলেন, প্রধানত গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভাজন ও দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই শাসকশ্রেণী একে ব্যবহার করছে। শ্রেণী আন্দোলন, শ্রেণী সংহতি ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে পরিচিতিসত্তার আন্দোলনকে ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বামপন্থী আন্দোলনকে ধৈর্যের সঙ্গে এই বিষয়কে মোকাবেলা করতে হবে। বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে সমস্ত ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বামপন্থীদেরই সেই সব দাবিকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শ্রেণী ও সামাজিক শোষণের বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমরা যদি এ কাজ না করতে পারি, তবে তা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে চলে যাবে। ’
তিনি আরো বলেন, পুরোনো রাজনৈতিক স্লোগান যেখানে মানুষের চাহিদাকে পূরণ করতে পারছে না, সেখানে নতুনভাবে স্লোগান দেওয়ার কথা ভাবতে হবে।
নয়া-উদারবাদী নীতির এই বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে বামপন্থীদের সামনে বিকল্প কী, সেই প্রশ্নকে ব্যাখ্যা করে প্রকাশ কারাত বলেন, সমাজতন্ত্রই পুঁজিবাদের এখনও এবং একমাত্র বিকল্প।
পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ বিভিন্ন দেশে বিশ শতকে সমাজতন্ত্র গঠনের অভিজ্ঞতা থেকে একবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্র গঠনের কাজ যে ভিন্ন হবে তা ব্যাখ্যা করে কারাত বলেন, বিশ শতকে সমাজতন্ত্রের ইতিহাসকে কখনই মোছা যাবে না। সেখানে যেরকম অজস্র সাফল্য আছে, তেমনি কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও রয়েছে। আমরা সাফল্য থেকে শিক্ষা নিলেও নিশ্চয়ই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবো না। লাতিন আমেরিকায় দেশের পর দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জয়ী হয়ে সরকারগুলো নয়া-উদারবাদী নীতিকে খারিজ করে বিকল্পের পথে হাঁটছে। সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে হটিয়ে তাঁরা একুশ শতকের সমাজতন্ত্র গড়ার কথা বলছেন। চীনও দ্রুত বিকাশের পথে এগোচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালে চীন অর্থনীতির আয়তনে আমেরিকাকেও ছাপিয়ে যাবে।
কারাত বলেন, এই সময়ে মৌলিক সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকেও তীব্র হতে দেখা যাচ্ছে। বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে এটা একটা উর্বর সময়। বামপন্থীদের এই সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৫ ঘন্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১২