কলকাতা: বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন বিহার রাজ্য আজকের ঝাড়খণ্ডের জামদেশপুরের প্রবাসী বাঙালি একটি মেয়ে কমলা ঘোষ লিখে ফেললেন বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি।
আর আশ্চর্য ভাবে সেই চিঠির জবাব এলো স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ঠিক ৩ মাস ২ দিন পর।
চিঠিতে কমলা দেবী লিখেছিলেন, ‘পরম শ্রদ্ধেয় শেখ মুজিবুর রহমান। আমি ভারতবাসী, জামশেদপুরের মেয়ে, আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছি। আমাদের পরম সৌভাগ্য, আপনি ফিরে এসেছেন অন্ধকারের কারাগৃহ থেকে স্বাধীন বাংলার নতুন আলোকে-এ এক দুর্লভ শুভলগ্ন....। ’
চল্লিশ বছরের সেই স্মৃতি নিয়ে আজও একুশের দিনটি স্মরণ করেন কমলা দেবী। বাংলানিউজকে বলছিলেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, শুনেছিলম বঙ্গবন্ধুর সেই মার্চের ভাষণ। খুব মনে ধরে গেল কথাগুলো। মনে মনে ছটফট করছিলাম। বাংলা ভাষা আর বাঙালির জন্য এত দরদ তার! তখন কোথায় টিভি, কোথায় বা ইন্টারনেট? আকাশবাণীতে শুনেছিলাম। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় লিখে ফেললাম চিঠি। পাঠিয়ে দিলাম। ঠিকানা জানা ছিল না। শুধু বঙ্গবন্ধুর নাম, ঢাকা আর বাংলাদেশ ব্যাস এই কটা শব্দ লিখে খামের ওপর লিখে দিলাম। ’
কিন্তু কমলা দেবীর চিঠি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর হাতে পৌঁছায়নি। কোনোভাবে তা হাতে পড়ে ঢাকার ছাত্রলীগ নেতা রবিউল ইসলামের। তিনি তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত রক্তপ্রবাহ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। তিনি চিঠিটি তার পত্রিকার সে বছর ভাষা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকাতে প্রকাশ করেন। আর তা হাতে পেয়ে পরম স্নেহে ভাষা দিবসের দিনটিতে খুঁজে পান বঙ্গবন্ধুর সীমান্তের ওপারে তার অচেনা এক বোনকে।
পরে চিঠিটি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও পাঠ করা হয়।
এর সূত্র ধরে ১৩ মার্চ ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু কমলার চিঠির উত্তর দেন। তাকে বোন সম্বোধন করে বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘স্নেহের বোন কমলা, রক্তপ্রবাহে লিখিত তোমার চিঠি আমি পড়েছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য, কিন্তু শোষকগোষ্ঠী আমাদেরকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। একটা সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপের ওপর বসে দেশকে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছি। তাই খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। তোমরা বাংলার মেয়ে, বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছো, তাই বাংলাকে ভালবাসো। ইতি তোমার মুজিব ভাই। ’
আবেগ বিহ্বল কমলা দেবী বলেন, সেদিন আমি চিঠিতে মুজিব ভাইকে লিখেছিলাম, ‘আমার বাংলা ভাষা কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা ভাবতেও বুকে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি সোনার বাংলায় বিশেষ অর্থ নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে। সেই অমর শহীদদের স্মরণে আমরাও এখানে বসে অশ্রুজলে অন্তরের শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করি। ’
আর বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার সংগ্রামে আমার ছেলেরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করেছে। আমার ৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মেয়ের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে ১ কোটি লোক ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। ’
তিনি আরো লিখেছিলেন, ‘এই চরম যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের সামরিক বাহিনী আর আপামর জনসাধারণ। ’
আবেগ তাড়িত হয়ে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছিলেন, ‘তোমরা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছো, রক্ত দিয়েছো। এ ঋণ আমি কোনো দিন পরিশোধ করতে পারবো না। আজ আমি রিক্ত, তোমাদেরকে দেবার মতো কিছুই নেই। আমার আছে শুধু ভালোবাসা, তাই দিলাম.......পৃথিবীর মানচিত্রে আমার রূপসী বাংলা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা, সবচেয়ে বড় পাওয়া। ’
বাংলাদেশ সময়; ১৭১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১২