ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্যে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্যে সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্য। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

সুন্দরবন ঘুরে: হুট করে বুঝি এসেই পড়লো মানুষখেকো। এতোক্ষণ আয়েসি তালে হাঁটতে থাকা ৮ জনের অ্যামেচার দলটা দাঁড়িয়ে গেলো বিস্তৃত চারণভূমির মাঝখানে। সবচেয়ে বেশী সতর্ক বনরক্ষী অজিত রায়। কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামিয়ে পশ্চিমের বনে চোখ রেখে বললেন, কাছেই বাঘ আছে।

তার কথাকে সত্য প্রমাণ করতেই বুঝি পশ্চিমের বন থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে থাকলো চিত্রা হরিণের দল। কোনো কোনোটা শ’দুই মিটার দূরে থমকে দাঁড়িয়ে অভিযাত্রী দলটাকে দেখলো এক পলকে।

তারপর ফের ছুট। কয়েক লাফেই হারিয়ে গেলো পূবের ঘাসবনে।  

সুন্দরবনের এ অংশটার ভূমিরূপ একেবারেই আলাদা। ক্যাওড়া আর বাইনের ঘনবনের মাঝে আয়তাকারে বিস্তৃত চারণ ভূমি, পুরোটাই সবুজে ছাওয়া। শক্ত মাটিতে কোনো পশুর ছাপ ফোটেনি ছোট ছোট ঘাসে। একটু পর পর ছাতা আকৃতির বরই গাছ। পূর্বদিকে বুক সমান উঁচু শনের বন। চারণভূমি চিরে সোজা এগিয়ে গেছে এক চিলতে পায়ে চলা পথ। কচিখালী সৈকতে বাঘের পায়ের ছাপ।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর

সবসময়ই এখানে চরতে থাকে হরিণের পাল। গাছের ডালে ডালে খেলা করে বানরের দল। কিন্তু এই মুহূর্তে বাঘের আগমনী আশঙ্কায় পুরো চারণভূমিটাই খাঁ খাঁ। গাছের ডগায় একটু আধটু দমকা বাতাসের দোলা ছাড়া আর কোনো নড়াচড়া নেই কোথাও। নিজের কানে ধরা পড়ছে নিজেরই নি:শ্বাসের শব্দ।

একটা বিচিত্র রঙা কাঠঠোকরা সামনের মাটিতে নাচলো কিছুক্ষণ। যেনো বার্তা দিলো সামনে এগুনোর। অ্যামেচার অভিযাত্রীরাও এবার সামনে বাড়তে শুরু করলো। তবে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে এবার অনেকটাই কমে গেছে চলার গতি।

পেছনে পড়ে রইলো চারতলা ওয়াচ টাওয়ার, বনবিভাগের কাটা মিঠা পানির পুকুর। চারণভূমি শেষে শুরু হলো জাম বন। দু’পাশে হাজার হাজার জাম গাছ। তার মাঝে দিয়ে সরু ট্রেইল। জামগাছের আধিক্যের জন্যই এ অংশটার নাম জামতলা। তবে জামগাছের ফাঁকে ফাঁকে নাম না জানা বিচিত্র লতা আর পেঁচানো গাছও চোখে পড়ে। কটকার চারণভূমি।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর একপাশে ভেজা মাটিতে শ্বাসমূল উঁচিয়ে থাকায় প্রাকৃতিক নিরাপত্তার কাজ হয়ে গেলো অনেকটাই। কেননা শক্ত শ্বাসমূল মাড়িয়ে বাঘ আসার সম্ভাবনা কম। কিন্তু বিপদটা তো ঠিকই রয়ে গেলো মাথার ওপরে।    

রয়েল বেঙ্গল টাইগার মূলত আক্রমণ করে সুযোগ বুঝে। টার্গেট ঠিক করে অনুসরণ করতে থাকে মোক্ষম সময় পর্যন্ত। টার্গেট ফসকাবে না বুঝতে পেরে লাফ দিয়ে কামড়ে ধরে মাথার পেছনে ঘাড়ে। বাঘকে বিভ্রান্ত করতে তাই মাথার পেছনে মুখোশ সাঁটার কৌশল নিয়েছিলো বনজীবীরা। কিছু দিন কাজও হয়েছিলো এ কৌশলে। মুখোশকে মুখ ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছিলো বাঘ। কিন্তু এক সময় চালাকিটা ধরে ফেলে সুন্দরবনের বুদ্ধিমান রাজা। এখন আর কাজ হয় না মুখোশে।

ট্রেইল শেষ হওয়ার আগেই কানে এলো সাগরের গর্জন। বর্ষায় জোয়ারে ডুবে যায় বলে বালু বেশী এদিকটায়। সেই বালু মাড়িয়ে বন থেকে বেরিয়ে আসতেই পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়তে শুরু করলো ফুঁসতে থাকা ঢেউ। স্বাভাবিক আবহাওয়াতেই ঢেউয়ের এতো তেজ হলে নিম্নচাপের সময়ে এখানে কতোটা ভয়ংকর রূপ ধরে বঙ্গোপসাগর? এখানকার চোরাবালিতে মানুষ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও তো নেহায়েত কম নয়। তীরে উল্টে পড়ে থাকা জাম-বাইনের সারি কিন্তু প্রমত্তা ঢেউয়ের আগ্রাসী রূপেরই পরিচয় ঘটিয়ে দিলো। জামতলার ট্রেইল।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর

ভয়ংকর সৌন্দর্যের সঙ্গে কিছু সময় দোস্তি গড়ার পর শুরু হলো সৈতক বাওয়া। এবার হাতের বাঁড়ে রইলো সুন্দরবন, ডানে ফুঁসতে থাকা বঙ্গোপসাগর। মাঝের ৩০/৪০ ফুট প্রশস্ত সৈকত ক্রমেই ছোট হচ্ছে ফুলতে থাকা জোয়ারে। পানির নিচে হারিয়ে যাচ্ছে সরু সরু কাঁকড়ার গর্ত।

হঠাৎ বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেলো ভেজা সৈকতে।   মাস আটেক আগেও এ সৈকতেই মিলেছিলো বাঘের পায়ের ছাপ। এমভি অবসরের মাস্টার দেখিয়েছিলেন ডেকে। তবে সেবার ছিলো এক সারি পা। এবার কিন্তু একাধিক বাঘের পায়ের ছাপ চোখে পড়লো।   বড় ছাপের পাশে ছোট পায়ের ছাপও আছে।  

এখনকার ছাপগুলো একেবারেই টাটকা। তার মানে এদিক দিয়ে বাচ্চাসহ বাঘ হেঁটে যাওয়ার পর খুব বেশী সময় গড়ায়নি। জোয়ারের পানি আর একটু বাড়লে যদিও এ ছাপটাও থাকবে না। পানির তোড়ে সমান হয়ে যাবে সৈকতের বালি। তাহলে কি হিসেব কষেই বাঘ হেঁটে গেলো ‍পানির কিনারায়! ভাটার সময়ে যে পথে হাঁটবে, প্রতিদিনের দু’দফা জোয়ার মুছে দেবে সেই পদচিহ্ন!বিপদজনক জামতলা সৈকত।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর

বুদ্ধিমান এ পশুর পক্ষে এমন আচরণ সম্ভবই বটে। কিন্তু বাঘের পায়ের ছাপের পাশে কাদের পায়ের ছাপ ওগুলো! একজোড়া খালি পা, আর একজোড়া বুটপরা পায়ের ছাপ। ওরা কি তবে শিকারী?

ভাবনায় ছেদ পড়ে মাইকের আওয়াজে। এ পথটাতে কেউ আসে না বটে, তবে বনের ওপাশ থেকে ঠিকই ভেসে আসছে লাউড স্পিকারের শব্দ। তাতে বলা হচ্ছে, আপনারা কেউ শব্দ করবেন না। শব্দ করলে বণ্যপ্যাণি ভয় পেয়ে দূরে সরে যাবে। বাঘের ডেরা শন বন।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর

মাইকিং করে এমন রসিকতায় হাসির রোল পড়লো সাংবাদিক দলের ভেতর। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে চাপতে থাকা ভয়ের আবহটা তাই হাওয়া হয়ে গেলো হাসির তোড়ে।   কিন্তু আরো দেড় কি দু‘কিলোমিটার সামনে বাড়ার পর দেখা দিলো মূল বিপত্তি।

জোড়া তালগাছের কাছে সৈকত ছেড়ে শন বনের দিকে এগুনোর কথা। কিন্তু ওদিকটাতে ঢুকতে গিয়ে লাফিয়ে সরে এলেন বন রক্ষী অজিত।   রাইফেলের বাঁটে শক্ত হয়ে চেপে বসেছে তার হাত। কটকা খালের একটি শাখা।  ছবি: শুভ্রনীল সাগর

ইশরায় দেখালেন সব ক’টা বাঘের পায়ের ছাপ এ পথে সেঁধিয়ে গেছে শন বনে। বুক সমান উঁচু শনের ঝোপে দু’হাত দূরে বাঘ ঘাপটি মেরে বসে থাকলেও বোঝা যাবে না। তারওপর বাচ্চা সঙ্গে থাকায় ধারেকাছে কাউকে পেলেই ঝাঁপি পড়বে মা বাঘ। এ সময়টায় বাচ্চাদের নিরাপত্তা চিন্তায় সবচেয়ে বেশী আক্রমনের মুডে থাকে মা বাঘ। এমনিতে সাধারণত ক্ষিদে ছাড়া শিকার করে না রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কিন্তু বাচ্চাদের ধারেকাছে কাউকে দেখলে ধাবা দিয়ে জীবন সাঙ্গ করতে সময় নেবে না। কাজেই এখন ওই বনে ঢোকার মানে হলো যেচে মৃত্যুর ফাঁদে পা দেওয়া।

অজিতের কথায় শিরদাঁড়ার ওপরে এতোক্ষণ চেপে থাকা ভয়ের স্রোত গতি পেলো যেনো। দরকার নেই শন বনের শটকাট রাস্তার।   এর চেয়ে সৈকতে আরো কয়েক কিলোমিটার হাঁটা ঢের ভালো। পা যতোই ক্লান্ত হোক, আকাশের উত্তাপ ঠেকিয়ে পৌষের বাতাস তো সঙ্গ দিচ্ছে ভালোই। এতোক্ষণ বাঘের পেছনে ছুটে সেই বাঘেরই ডেরা ছেড়ে যতো দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়া যায় ততোই ভালো। কিন্তু কচিখালী ফরেস্ট অফিসকে তো অনেক দূরের গন্তব্য বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।