ঢাকা: আকাশে মেঘের আনাগোনা, হঠাৎ বৃষ্টি। আসছে বর্ষা।
রূপালী জ্যোৎস্নায় হাওরের শীতল জলে নৌকায় ভেসে বেড়াতে ছুটে যাচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার সব বয়সের মানুষ। এসব কারণেই বর্ষার মৌসুমে পর্যটকদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে থাকে হাওরগুলো।
তবে দেশের হাওরাঞ্চলের পর্যটন বিগত পাঁচ বছর আগেও এতটা জমজমাট ছিল না। যতটা জমজমাট হয়েছে এই কয়েক বছরে। গেল কয়েক বছরে হাওরমুখী হয়েছেন প্রচুর পর্যটক।
দেশের সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ ও এর আশপাশের হাওরগুলোতে পর্যটনের ভিন্ন মাত্রা তৈরি করেছে সুসজ্জিত নৌকাগুলো। যে কেউ চাইলেই পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে নৌকাগুলোতে অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারেন কয়েকটি দিন। জীবন যাপনের সবগুলো সুযোগ সুবিধা রয়েছে নৌকাগুলোতে।
হাওর বিলাস ও পর্যটনের এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় ট্যুর গ্রুপ বিডির (টিজিবি) উদ্যোক্তা মো. ইমরানুল আলমের সঙ্গে। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে সিন্দাবাদ নামের একটি আধুনিক নৌকা রয়েছে তাদের। দীর্ঘ সময় হাওরের পর্যটন এবং পর্যটন ব্যবসা নিয়ে বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে এ উদ্যোক্তার।
হাওরের পর্যটনে সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় দেশ, তা বিগত ৫ বছরের অগ্রগতি খেয়াল করলেই মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। এদেশের মানুষ চমক পছন্দ করে, নতুনত্ব পছন্দ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় হাওরে নৌকায় রাত্রিযাপন একটি নতুন চমক এদেশের পর্যটকদের জন্য। বিগত চার থেকে পাঁচ বছর ধরেই মানুষ ক্রমান্বয়ে এ চমক পরখ করে আসছে যা প্রতি বছরই বেড়েই চলেছে।
প্রথমে শুরু হলো সাধারণ যাত্রীবাহী নৌকায় কোনভাবে রাত্রিযাপন, সেখানে মানুষের প্রচুর আগ্রহ খেয়াল করা গেছে। তারপর নৌকায় আনা হলো ভালো ওয়াশ রুম, ফ্যান-লাইট, জেনারেটর। এই ধারাবাহিকতায় এলো নৌকার ভেতরে সহজেই চলাফেরা করার বিষয়।
সর্বশেষ নৌকার ভেতরে কেবিন, লবি, আইপিএসসহ রিসোর্ট সমমানের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত দৃষ্টি নন্দন হাউস বোট। প্রতিটি ধাপেই মানুষের আগ্রহের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ছুটির দিনগুলোতে নৌকা পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যায়। এতে স্পষ্টতই বলা যায় হাওরের পর্যটন অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।
এছাড়া হাওরের পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে পুরো সুনামগঞ্জ জেলা এবং আশেপাশের কিছু থানারও জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেড়েছে। এর কারনে ক্রমান্বয়ে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে। এটিও সম্ভাবনার আরও একটি কারণ বলা যায়।
হাওরের পর্যটনের অপার সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও উল্লেখ করেন এই উদ্যোক্তা।
তিনি জানান, কোন স্থানে পর্যটন নতুনভাবে বৃহৎ আকারে শুরু হলে সেই এলাকার পুরো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চিত্রই বদলাতে থাকে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রাস্তাঘাট এবং ব্রিজগুলো পর্যটন বান্ধব না হওয়া একটি প্রতিবন্ধকতা।
মেঘালয়-আসামের অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢলে পানি বেড়ে গেলেই অনেক জায়গায় রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, ফলে যাতায়াত দুরূহ হয়ে পড়ে। আবার অন্য দিকে ব্রিজগুলো নিচু হওয়ায় বর্ষার পানি বাড়লে নৌকাগুলো ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে পারে না।
এর কারণে চাইলেও খুব বেশি উঁচু করে নৌকা বা হাউস বোট বানানো যায় না।
এদিকে স্থানীয়দের মধ্যে কিছু মানুষ সাপোর্টিভ হলেও অনেকেই পর্যটনমুখোর দিনগুলোতে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
এছাড়া টেকেরঘাটে নৌকাগুলো ভেড়ানোর জন্য কোন জেটি নেই, এটিও এখন সময়ের দাবি। তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আমাদের অসচেতনতা। এখনও অনেকেই অপচনশীল দ্রব্য হাওরের পানিতে ফেলে পানিকে দূষিত করছে। আবার অনেকেই উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে হাওরের নিরবতাকে বিষিয়ে তোলে।
বিষয়গুলোতে স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ আরেকটু সজাগ দৃষ্টি দিলে আরও অনেক প্রতিবন্ধকতা অচিরেই কেটে গিয়ে হাওরের পর্যটন আরও সমৃদ্ধ হবে।
হাওরে বিনিয়োগ নিয়ে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে হাওরের বিনিয়োগের রিটার্ন তুলনামূলক একটু ধীর গতির হয়। হাওরের পর্যটন নির্ভর করে বর্ষাকালীন থৈ থৈ করা পানির ওপরেই। মানুষ মূলত ভরা বর্ষায়ই হাওরে বেড়াতে বেশি পছন্দ করে। বর্ষাকাল তো থাকে অল্প সময়ে।
মূলত জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভরা বর্ষা থাকে, এবং জমজমাট বিজনেসটা এই তিন মাসেরই হয়। নতুন আইডিয়া নিয়ে যারা এক ধাপ এগিয়ে থেকে পরিকল্পনা করে, তারা তুলনামূলক দ্রুতগতির ফিডব্যাক আদায় করে নিতে পারে বা পারবে।
নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে ইমরান বলেন, আমরা টিজিবি থেকে ২০১৫ সালে নিজেদের প্রথমবারের মতন টিম নিয়ে হাওরে গিয়ে রাতে নৌকায় থেকেছিলাম। ব্যাপার টা আমাদের ভালো লাগে এবং আমরা ব্যাপকভাবে এর প্রচার করি এবং নিজেরা নিয়মিত হাওরে ভ্রমণে উৎসাহিত করতে থাকি অন্যদেরও। মানুষ এতে কল্পনাতীত সাড়া দেয়।
২০১৯ সালে আমরা ‘সিন্দাবাদ তরী’ নামে একটি ততকালীন অত্যাধুনিক একটি নৌকা তৈরি করি। সেই সঙ্গে সাউন্ডলেস জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করি যার মাধ্যমে ফ্যান-লাইট-চার্জিং সুবিধাসহ বেসিক চাহিদা পূরণ হয়। মানুষের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সিন্দাবাদ তরীতে এখন কেবিনও সংযুক্ত করা হয়েছে।
যদিও মাঝে দুই বছর করোনাভাইরাস এর প্রভাবে লকডাউন এর কারণে অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে হাওরের পর্যটন, তারপরও সবকিছু মিলিয়ে ফিডব্যাক আলহামদুলিল্লাহ সন্তোষজনক।
হাওরের পর্যটন নিয়ে স্থানীয়রা জানায়, বিগত কয়েক বছর যাবত হাওরে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। বর্ষা এলে প্রচুর মানুষ আসে। পর্যটকদের এই আনাগোনায় সমৃদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থা। স্থানীয়দের অনেকেই এখন এ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।
হাওরের পর্যটন সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই সাত জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে চারটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি হাওর রয়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এ হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল অঞ্চলে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্ষাকালে হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওরপাড়ের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পর্যটকদের মনে।
হাওরের পর্যটন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে বাংলাদেশের হাওরের পর্যটন এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সঠিক প্রচার-প্রচারণা করা হলে হাওরের রূপ দেখতে আসবে বিদেশিরাও।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০২২
এসএইচডি/এনএইচআর