আদিবাসী উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ব্যাতি রেখে একটি দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে কল্পনা করা যায় না বা পূর্ণতা পায় না। এর অর্থ এই যে- বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন গোষ্ঠীতে আদিবাসী, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় যতগুলো উপজাতি রয়েছে মুন্ডাকে তার মধ্যে বৃহৎ পরিসরের উপজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতের ঝাড়খন্ড ও রাচি এলাকায় তাদের আদি নিবাস কিন্তু ধর্ম ও সংস্কৃতি ভারতের। ঝাড়খণ্ড ও ছত্রিশগড় রাজ্যের ছোটনাগপুর অঞ্চল, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে তাদের বাস। এছাড়া, বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে তারা বাস করে।
বাংলাদেশে মুন্ডাদের ৭টি গোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো-
কম্পাট মুন্ডা, খাঙ্গার মুন্ডা, খাড়িয়া মুন্ডা, পাথর মুন্ডা, দেরগে মুন্ডা, সাঙ্কা মুন্ডা এবং মাঙ্কী মুন্ডা।
ভারতবর্ষে প্রধানত ১৩টি মুন্ডা গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ রয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার (সামস) দেওয়া তথ্যমতে- বর্তমানে শ্যামনগরে মুন্ডাদের ৪২০টি পরিবারের জনসংখ্যা ২ হাজার ৭৪০। এসব পরিবারের ৯৫ শতাংশ ভূমিহীন। অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অভাবকে পুঁজি করে ভূমিদস্যুরা তাদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে। বর্তমানে চার শতাধিক পরিবারের মধ্যে তিনজন গ্রাম পুলিশ এবং ১৩ জন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। অন্য সদস্যরা দিন মজুরের কাজ করেন।
বাংলাদেশের খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুন্ডাদের বসতি বিন্যাসের এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর ম্যান গ্রোভ সুন্দরবন এলাকায়ও এদের আদি বসতির চিহ্ন মিলে।
ভাষা
শাদ্রী ভাষা ভুলতে বসেছে বর্তমান প্রজন্ম। প্রাথমিক পাঠ শেষে শিশুরা ঝরে যাচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে মুন্ডাদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো- অপ্রতুল স্কুল ব্যবস্থা এবং তাদের নিজস্ব পারিবারিক ও ভাষাগত চর্চায় নিরুৎসাহ করা। তবে বর্তমানে মুন্ডারা বিভিন্ন এনজিও এবং সমাজ পতিদের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় মুন্ডারা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতিচর্চাও করতে পারছে না। অস্ট্রো- এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীনতর। অসংখ্য মুন্ডা শব্দ বাংলা ভাষায়, বিশেষত আঞ্চলিক ভাষায় বিদ্যমান। বাংলা বাগভঙ্গির ওপর মুন্ডা ভাষার প্রভাব আছে। মধ্য প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক কোটি লোক মুন্ডা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার। তিন-চার হাজার বছর পূর্বে মুন্ডারা পিজিন ভাষা হিসেবে পেশা ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রথম মুন্ডা ভাষা ব্যবহার করে।
পেশা /জীবিকা
বর্তমানে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কালিঞ্চি, ভেটখালী, তারানিপুর, সাপখালী, ধুমঘাট, মুন্সিগঞ্জ, কাশিপুর, কচুখালী এলাকায় নদীর তীরে সরকারি খাস জমিতে বাস করে আদিবাসী মুন্ডারা। আগে তাদের প্রধান জীবিকা ছিল সুন্দরবনের গাছ কাটা, নদীতে মাছ শিকার ও কৃষিকাজ। বর্তমানে তাদের অনেকেই আদি পেশা ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
প্রতিকূল পরিবেশে কঠোর পরিশ্রম করতে পারে এ সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসকরা সমতল ভূমির বন জঙ্গল কেটে কৃষি উপযোগী করাসহ পরিচ্ছন্ন হাট-বাজার ও নগর গড়ে তোলার জন্য তাদের নিয়ে আসে এদেশে। এক সময় তাদের সুন্দরবনের গাছ কেটে জন বসতি গড়ার কাজে লাগানো হয়। সময়ের আবর্তে মুন্ডা সম্প্রদায়ের পেশার সঙ্গে কাজের ধরনও বদলে যায়। এরপর থেকেই তারা এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীর পাশে বসতি গড়ে তোলেন।
সাংবিধানিক অধিকার
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ (ক) রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করবে। সংবিধানের কোথাও আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়াও সংবিধানের ২৮ ধারায় উল্লেখ আছে- জনগণের যেকোনো অনগ্রসর অংশকে অগ্রসর করার নিমিত্তে, সুবিধা দেওয়ার নিমিত্তে রাষ্ট্র যেকোনো প্রকার বন্দোবস্ত নিতে পারবে এবং সংবিধানের অন্য কোনো ধারা সেটাকে বাধা দিতে পারবে না। যেমন- শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, বিসিএস নিয়োগে কোটা ইত্যাদি।
লেখা: শেখ শোয়েব আহম্মেদ, শিক্ষার্থী (সমাজকর্ম বিভাগ)
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২
জেডএ