ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩২, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

ইসলাম

ধর্মচিন্তায় স্খলন রোধে করণীয়

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৯, অক্টোবর ৭, ২০২৫
ধর্মচিন্তায় স্খলন রোধে করণীয় চম্পানির জামে মসজিদ, গুজরাট, ভারত। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের জীবনের চিন্তার প্রভাব গুরুতর। সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা যেমন মানুষকে সুপথে নিতে পারে, তেমন চিন্তার স্খলন মানুষকে বিপথগামী করতে পারে।

কখনো চিন্তার স্খলন পুরো সমাজ ও জাতিকে বিপন্ন করে তোলে। বিশেষত ধর্মীয় জীবনে চিন্তার স্খলনের প্রভাব হয় অত্যন্ত ভয়াবহ।

নিম্নে চিন্তার স্খলন রোধে মুসলিম উম্মাহর করণীয় বিষেয় আলোচনা করা হলো।
 
চিন্তার স্খলন কাকে বলে

চিন্তার স্খলন হলো মানুষের ভাবনা ও বিশ্বাসের এমন বিকৃতি ও পরিবর্তন, যা ঐশী জ্ঞান ও মানব প্রকৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে যা অযৌক্তিক ও অরুচিকর, যার ফলাফল নেতিবাচক। এই বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য আমি তাদের অভিশাপ করেছি এবং তাদের হৃদয় কঠিন করেছি।

তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে এবং তারা যা উপদিষ্ট হয়েছিল তার একাংশ ভুলে গেছে। তুমি সর্বদা তাদের অল্পসংখ্যক ছাড়া সবাইকেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেখবে। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১৩)
 
ধর্মচিন্তায় স্খলন গুরুতর

চিন্তার যেকোনো বিকৃতিই নিন্দীয়, তবে ধর্মচিন্তায় বিকৃতি ও স্খলন অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। মহানবী (সা.) এই বিষয়ে উম্মতকে সতর্ক করেছেন।

তিনি বলেছেন, ‘তোমরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পরিহার কোরো। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০৫৭)
 
চিন্তার স্খলনে ধ্বংস হয় যে রাজত্ব

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, উমাইয়াদের রাজত্ব ধ্বংসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শেষ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান বিন মুহাম্মদের চিন্তার স্খলন। তাঁর শিক্ষক জাআদ বিন দিরহামের বিকৃত চিন্তার কারণে সে চিন্তার স্খলনের শিকার হয়েছিল। জাআদ আল্লাহর জাত ও সিফাতের ব্যাপারে বিকৃত চিন্তা লালন করত।

তিনি বলেন, মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ জাআদির ওপর জাআদের কুপ্রভাব পড়েছিল। এমনকি তাঁদের রাজত্ব বিলীন হয়। তাঁর থেকে এমন বিদআত প্রকাশ পেয়েছিল তার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দ্বিনের বিরোধী। ফলে আল্লাহ তাঁর রাসুলের বিরোধিতাকারীর থেকে প্রতিশোধ নিলেন এবং তাদের পরাস্ত করলেন। (মাজউল ফাতাওয়া : ১৩/৯৬)
 
ধর্মচিন্তায় স্খলনের নানা রূপ

ধর্মচিন্তায় মানুষ যে ধরনের স্খলনের শিকার হয় তাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—

১. ঈমান ধ্বংসকারী স্খলন : বিশ্বাসের এমন স্খলন ও বিকৃতি, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। সেটা আবার কয়েক প্রকার হতে পারে।

ক. নাস্তিক্যবাদ বা স্রষ্টায় অবিশ্বাস।

খ. ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাওয়া।

গ. আহলে কিতাবদের বিকৃত চিন্তার অনুসরণ করা। যেমন— ত্রিত্ববাদ, বান্দার জন্য আল্লাহর গুণাবলি এবং আল্লাহর জন্য বান্দার বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা ইত্যাদি।

ঘ. শিরকে লিপ্ত হওয়া।

২. চিন্তার ভারসাম্য নষ্টকারী স্খলন : বিশ্বাস ও চিন্তার এমন বিকৃতি, যা ব্যক্তিকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তবে তাকে ইসলামের গণ্ডির বাইরে বলা যায় না। মুসলিম সমাজের অধিকাংশ বিকৃতি ও স্খলন এই প্রকারভুক্ত। যেমন—খারেজি, রাফেজি, কাদরিয়া ও মুরজিয়া সম্প্রদায়।

৩. নৈতিকতার পরিপন্থী স্খলন : এটা হলো এমন স্খলন, যা মানুষকে ঈমানের পরিপন্থী নয়, যা ভারসাম্যের পরিপন্থী নয়, তবে তা নৈতিকতার পরিপন্থী। যেমন—কেউ যদি ঈমান ও ইবাদতের স্থানে ঠিক থাকে, কিন্তু গুনাহ ত্যাগের ব্যাপারে শিথিল চিন্তার অধিকারী। এমন চিন্তার স্খলন নৈতিকতার পরিপন্থী। (শরহুল মুখতার, পৃষ্ঠা ১৪৮)

চিন্তার স্খলন কেন হয়

প্রাজ্ঞ আলেমরা চিন্তার স্খলনের বেশ কিছু কারণ বর্ণনা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—

১. ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা : মানুষের জীবনে শিক্ষার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। চাই তা প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক বা সামাজিক শিক্ষা হোক। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষার প্রভাবে মানুষ চিন্তার স্খলনের শিকার হয়। যেমন—শিকার হয়েছিল উমাইয়া খলিফা মারওয়ান বিন মুহাম্মদ জাআদি। মুতাজিলি আলেম আহমদ বিন আবু দাউদের প্রভাবে খলিফা মামুন ভ্রান্ত মুতাজিলি মত গ্রহণ করেন এবং যার প্রভাব খলিফা মুতাসিম, ওয়াসিক ও মুতাওয়াক্কিল পর্যন্ত বহাল ছিল।

২. শাসকদের স্খলন ও ভুল নীতি : শাসকরা সহজেই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের চিন্তার স্খলন ও ভুল নীতি প্রজা সাধারণকে সহজেই চিন্তার স্খলনের শিকার করে। বলা হয়ে থাকে, ইসলামপন্থার দমনে মিসরীয় শাসকদের ধারাবাহিক কঠোর নীতি সেখানে নানা ধরনের চরমপন্থার তৈরির জন্য দায়ী।

৩. ধর্মীয় জ্ঞানের অপূর্ণতা : ধর্মীয় জ্ঞানে অজ্ঞতা ও অপূর্ণতা মানুষকে চিন্তার স্খলনের শিকার করতে পারে। ইসলাম সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান না থাকলে মানুষ পার্শ্বচিন্তা বা ধর্মচিন্তায় স্খলনের শিকার হতে পারে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘অতি শিগগির এমন মানুষ আসবে, যারা তোমাদের সঙ্গে কোরআনের সংশয়পূর্ণ (অস্পষ্ট) বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক করবে। তোমরা তাদেরকে সুন্নাহ দিয়ে পাকড়াও করবে। কেননা সুন্নাহর অনুসারীরা আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অধিক অবগত। ’ (সুনানে দারেমি, হাদিস : ১১৯)

৪. অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে জ্ঞানচর্চা : ইসলাম সম্পর্কে চিন্তার স্খলনের শিকার হওয়ার বড় একটি কারণ হলো অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ইসলামের পাঠ গ্রহণ। বিশেষত প্রাচ্যবিদদের রচিত গ্রন্থগুলো ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অন্যতম কারণ। মুহাম্মদ বিন সিরিন (রহ.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সনদ দ্বিনের অংশ। সুতরাং তোমরা পরখ করে দেখো তোমরা কার কাছ থেকে দ্বিন গ্রহণ করছ। ’ (সহিহ মুসলিমের ভূমিকা)
 
ধর্মচিন্তায় স্খলন রোধে করণীয়

ধর্মচিন্তায় স্খলন রোধে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি করণীয় হলো—

১. বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা : ইসলামী জ্ঞানের বিশুদ্ধ চর্চা ধর্মচিন্তায় স্খলন রোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যুগশ্রেষ্ঠ আলেমরা এই নীতিকেই তাঁদের কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যেমন— ইমাম শাফেয়ি (রহ.), যাঁর মৃত্যু হয়েছিল ২০৪ হিজরিতে, তাঁর যুগে বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা কোরআন-হাদিসের বিশুদ্ধ জ্ঞান চর্চা করে এবং ভ্রান্ত মতবাদের বিপক্ষে সঠিক মত তুলে ধরে মুসলিম উম্মাহকে চিন্তার স্খলন থেকে রক্ষা করেছিলেন।

২. ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা : ভিন্নমতের প্রতি কঠোর মনোভাব সমাজে প্রান্তিকতা সৃষ্টি করে এবং ধর্মীয় চিন্তায় নানা ধরনের বিকৃতি সাধন করে। এ জন্য ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হয়ে তাদের সংশোধনের উপায় খুঁজে বের করা আবশ্যক। এটাই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘আমার অনুগ্রহ সব কিছুতে ব্যাপ্ত। ’

(সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৬)

আর রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে জগত্গুলোর জন্য অনুগ্রহস্বরূপ প্রেরণ করেছি। ’

(সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

৩. প্রান্তিকতা পরিহার : প্রান্তিকতা বা ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি ধর্মচিন্তায় স্খলনের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই সমাজ থেকে চিন্তার স্খলন রোধে যেকোনো ধরনের প্রান্তিকতা পরিহার করা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি পরিহার কোরো। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়ে গেছে। ’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০৫৭)

৪. উত্তম প্রতিরোধ : বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা ও সহনশীলতার পাশাপাশি স্খলনগুলোর বিরুদ্ধে উত্তম প্রতিরোধ গড়ে তোলাও আবশ্যক। তা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তর প্রদান এবং আইনানুগ প্রতিবাদ করা। যেন ভ্রান্তচিন্তার মানুষগুলো ইসলাম ও মুসলমানকে দুর্বল ভেবে না বসে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কোরো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কোরো উত্কৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। ’

(সুরা: হা-মিম-সাজদা, আয়াত: ৩৪)

আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।