বাংলাদেশের প্রথম নারী মুনাজ্জিম হওয়া ও নিজের হজ পালন, এজেন্সির যাবতীয় সেবাকর্ম ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে দারুণ এবং প্রাণবন্ত একটি আলাপচারিতা হয়ে গেল তার সঙ্গে। বাংলানিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তার স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির প্রায় সব কথা ওঠে এসেছে।
আলোচনা শুরু হয় আয়েশার হজে যাওয়ার প্রেক্ষাপট সুন্দর ও আবেগঘন বর্ণনা দিয়ে। তিনি বলেন, মা-বাবার হজে যাওয়া দেখে তারও প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয়। আশপাশের কোনো নারী হজে যাচ্ছেন শুনলে তার সামানপত্র গুছিয়ে দিতে ওই বাড়ি চলে যেতাম। সাধ্যানুযায়ী জিনিসপত্র গোছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতাম।
অন্যদিকে হজের নিয়তে প্রতি মাসে ১০০/২০০ করে টিউশনির টাকা জমা করতে শুরু করি। আচমকা অল্প খরচে হজে যাওয়ার একটা অফার আসে। কিন্তু যাবতীয় খরচের পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ছিল না। হজের উদ্দেশে জমানো টাকা গুণে দেখলাম মাত্র ৪২০০ টাকা। এরপর বাকিটা আমার আম্মা নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে ব্যবস্থা করে দেন। আর বার হাজার টাকার মতো আমার এক বান্ধবি ব্যবস্থা করে দেয়। ২০০৪ সালের সেই পবিত্র ও আনন্দঘন মুহূর্তের কথা মনে এলেও এখনো হৃদয়-মন আপ্লুত হয়।
হজের সফরে দোয়া কবুল হওয়ার সব জায়গায় খুব কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করি। বেশ কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন আমাকে প্রত্যেক হজে এ পুণ্যভূমিতে আসার তাওফিক দান করেন।
এরপর দেশে এসে ভাবলাম, সহজে প্রত্যেক বছর হজে যেতে হলে নিজস্ব হজ ও ট্রাভেল এজেন্সি ইত্যাদি করা দরকার। কিছুদিন পর পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শুরু করি। তবে শুরুর দিকে অন্য গ্রুপের সঙ্গে যেতাম। নারী হজ-ওমরা পালনার্থীদের দিক-নির্দেশনা দিতাম। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আমার প্রতিষ্ঠান ‘হজ উইথ আয়েশা’র নামে লাইসেন্স (২০১৭ সালে) করা হয়। ফলে ২০০৪ সালের পর থেকে প্রতি বছর আল্লাহর মেহেরবানিতে হজে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
আয়েশার হজ এজেন্সির নাম ‘হজ উইথ আয়েশা’। হজ-ওমরা দু’টোরই লাইসেন্স রয়েছে তার। শুরুতে কিছুটা ‘অন্য রকম’ মনে হলেও সৌদিতে বাংলাদেশের একমাত্র নারী মুনাজ্জিম ও হজ কাফেলার পরিচালক হিসেবে তার বেশ নাম-ডাক।
নারী হওয়ার কারণে বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজে ব্যাঘাতের সৃষ্টি হয় কিনা জানতে চাইলে আয়েশা বলেন, ‘নারী হওয়ার কারণে দেশে কিংবা সৌদিতে তার কাজে কোনো ধরনের ব্যাঘাত তৈরি হয় না। বরং সৌদি আরবের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আমি সর্বাত্মক আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ সহযোগিতা লাভ করি। এমনকি নারী হওয়ার কারণে আমার কাজ দ্রুত সময়ে ও সবার আগে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ’
মক্কা-মদিনায় বাড়ি ভাড়া, মোয়াল্লেমদের সঙ্গে চুক্তিসহ ‘হজ উইথ আয়েশা’র নানান প্রক্রিয়ার মৌলিক ও প্রধান কাজগুলো তিনি নিজেই করে থাকেন। প্রতি সফরে তার কাফেলায় একজন করে মাওলানা নিয়ে যাওয়া হয়, যিনি হাজি ও ওমরাপালনার্থীদের সার্বিকভাবে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। আর তিনি বেশ সাহস ও গর্বের সঙ্গে বলেন, মহিলাদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা গাইডের ব্যবস্থা রয়েছে। যা অন্য এজেন্সিগুলোতে নেই।
বাংলাদেশের প্রথম নারী মুনাজ্জিম হওয়ার মধুময় ও নাতিদীর্ঘ কাহিনী বেশ সংক্ষেপে শোনানোর চেষ্টা করেন আয়েশা। তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশের কোনো নারী মুনাজ্জিম না থাকায় আমি বারবার চাচ্ছিলাম, আমিই যেন প্রথম নারী মুনাজ্জিম হতে পারি।
কিন্তু সৌদি দূতাবাস আমাকে ওমরার ভিসা দিলেও ‘মুনাজ্জিমের ভিসা’ দিতে রাজি নয়। সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দূতাবাসের কাউন্সিলরের সঙ্গে দেখা করি। তিনি এক কথায় জানালেন, তারা কোনো নারীকে মুনাজ্জিমের ভিসা দেন না।
তবে আমার বিশ্বাস ছিল আমি মুনাজ্জিমের ভিসা পাবো এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী মুনাজ্জিম হতে পারবো। মক্কার বিখ্যাত হোটেল ব্যবসায়ী মাসুদ ভাই জানালেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ একজন এর আগে ইতালিয়ান নারীকে মুনাজ্জিমের ভিসা দিয়েছে। মনে হলো, তাদের কাছে ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে ও উদাহরণ টেনে আবার চেষ্টা করা যায়।
আমিও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়। আমাকে নারী মুনাজ্জিম হিসেবে সৌদিকর্তৃপক্ষ ভিসা দেয়।
আমার গর্ববোধ হয়, কারণ এখন আমিই বাংলাদেশের নারীদের জন্য রেফারেন্স হতে পারবো যে, আমাকে মুনাজ্জিম বানানো হয়েছে।
আমি আমার কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সরকারের কাছে চির কৃতজ্ঞ। পরপর তিনজন সহযোগিতাপ্রবণ সচিবকে পাই। তারা আমাকে বেশ সৌহার্দপূর্ণ সহযোগিতা করেন। বর্তমানে ধর্মপ্রতিমন্ত্রীসহ মন্ত্রাণালয়ের সবার হৃদ্যতাপূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি ও পাচ্ছি।
আয়েশা চৌধুরী নারী হাজিদের সেবায় বাংলাদেশ হজ মিশনকর্তৃক ‘নারী হজকর্মী’ হিসেবে নিযুক্ত। তবে তিনি কাজটি স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে করে যাচ্ছেন।
হজসেবার পাশাপাশি দেশের অসহায় মেয়েদের নিয়ে কাজ করার প্রবল আগ্রহ আয়েশা চৌধুরীর। লেখাপড়ার পাশাপাশি আয়েশা চৌধুরী স্বপ্ন দেখতেন গরিব-অসহায় নারীদের কষ্ট দূর করার। ২০১৩ সালে অসহায়-গরিব ও বিধবা নারীদের কল্যাণে তিনি ‘স্বপ্নফেরী সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বপ্নফেরী সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা, ‘এখানে নারীদের বিভিন্ন রকম হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বৃদ্ধ, অসহায়দের বিনা সুদে অর্থ ও বিভিন্ন মৌসুমে কাপড় বিতরণ করা হয়। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের মাধ্যমে একশ জন অসহায়ও যদি সাবলম্বী হতে পারে তা আমাদের আনন্দ ও সওয়াবের কারণ হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় অনার্স মাষ্টার্স শেষ করা আয়েশা চৌধুরী তার এজেন্সি সম্পর্কে বলেন, আমি আমার এজেন্সিকে শুধু ব্যবসার মাধ্যম মনে করি না। কিংবা শুধু পার্থিব ব্যবসার জন্য খাটাই না। বরং এ এজেন্সির মাধ্যমে আমি প্রতি বছর হজ-ওমরা আদায় করতে পারছি। এটা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে একটা কোর্স করার আগ্রহ আছে। ভাষাদক্ষতার কারণে সৌদিতে বিভিন্ন কাজ করা যেন সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে আয়েশা চৌধুরী জানান, ২০১৭ সালে হজক্যাম্পের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। সেবা ও কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি আমার অনুপ্রেরণা। আমি প্রাধানমন্ত্রীর দোয়া সঙ্গে করে অনেকদূর নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আমার মেধা-শ্রম, সেবাশক্তি ও সামর্থ্য বাংলাদেশ সরকারের কাজে নিয়োজিত করতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যের অধিকারী মনে করবো।
আয়েশা ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার সদর থানার চিনাইর গ্রামের এস বি চৌধুরীর মেয়ে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৮
এমএমইউ/এসএইচ