ভারত-শাসিত কাশ্মীরের তুষারে ঢাকা মনোরম শহর গুলমার্গে গত ৭ মার্চ একটি ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা এখনও চলছে।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড শিবান অ্যান্ড নরেশের অনুষ্ঠানটি তাদের স্কি খেলার পোশাক প্রদর্শনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিষয়টি দ্রুতই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষ, রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতাদের ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে।
ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘এলে ইন্ডিয়া’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করে, যেখানে কিছু মডেলকে অন্তর্বাস বা বিকিনি পরা অবস্থায় দেখা যায়। অনলাইন ম্যাগাজিন ‘লাইফস্টাইল এশিয়া’র শেয়ার করা আরেকটি ভিডিওর কারণেও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ভিডিওতে শো শেষে আয়োজিত একটি পার্টির দৃশ্য দেখানো হয়েছে। সেখানে লোকজনকে প্রকাশ্যে মদ্যপান করতে দেখা গেছে।
পবিত্র রমজান মাসে মুসলমানদের সিয়াম সাধনা ও প্রার্থনার সময় এমন আয়োজন নিয়ে ক্ষুব্ধ হন অনেকেই। তারা ডিজাইনারদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিশ্বাসকে উপহাস ও স্থানীয় সংস্কৃতি এবং অনুভূতিকে অবজ্ঞা করার অভিযোগ করেন। কয়েকজন ধর্মীয় নেতা অনুষ্ঠানটিকে ‘অশ্লীল’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন যে, আয়োজনটি ‘সফট পর্নের’ মতো।
আবার কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেছেন, এই ক্ষোভ কেবল ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে নয়। বরং ‘বহিরাগতদের’ কাছ থেকে সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার ভয় থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। এমন প্রতিক্রিয়ার ফলে এলে ইন্ডিয়া ও লাইফস্টাইল এশিয়া তাদের ভিডিওগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ডিজাইনার শিবান ভাটিয়া ও নরেশ কুকরেজাও ক্ষমা চেয়েছেন। তারা বলেছেন, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সৃজনশীলতা উদযাপন করা। তারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে চাননি।
ফ্যাশন শো নিয়ে বিতর্কটি সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাশন আয়োজন, এরপর আবার পার্টি নিয়ে আলোচনা জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় হট্টগোলের জন্ম দেয়। সরকারের সমালোচনা করে বিরোধীদল স্থানীয় সংবেদনশীলতা সম্পর্কে জানা থাকার পরেও ওই ফ্যাশন শো’র অনুমতি দেওয়ার অভিযোগ তোলে।
এদিকে, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, অনুষ্ঠানটি বেসরকারি সংস্থা আয়োজন করেছে। তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন। তিনি বিধানসভায় বলেছেন, যদি আইন লঙ্ঘন করা হয়ে থাকে, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুষ্ঠানটি কে আয়োজন করেছে এবং কোন আইন (যদি থাকে) লঙ্ঘন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে পুলিশ বিস্তারিত জানায়নি।
স্কি খেলার পোশাক প্রদর্শনীর স্থান হিসেবে গুলমার্গকে বেছে নেওয়ার কারণ, এটি ভারতের অন্যতম স্কি খেলার স্থান। পর্যটকদের কাছেও জায়গাটি প্রিয়। ফ্যাশন সাংবাদিক শেফালি বাসুদেব বলেছেন, চমৎকার স্থানে ফ্যাশন শো করা ডিজাইনারদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। আলেকজান্ডার ম্যাককুইন এবং কার্ল লেগারফেল্ডের মতো আন্তর্জাতিক ডিজাইনাররা তাদের আইকনিক ডিজাইনের জন্য যতটা স্মরণীয়, ততটাই স্মরণীয় তাদের থিয়েটার ফ্যাশন শোয়ের জন্যও।
কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিতর্কের ঝুঁকি ডেকে আনে। তাই, কোন স্থানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে শেফালি বাসুদেব মন্তব্য করেন। আর তা বিশেষ করে কাশ্মীরের মতো স্থানে সত্য। সেখানে কয়েক দশক ধরে সশস্ত্র সংঘাত দেখা গেছে।
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ নিজের অংশ বলে দাবি করে। কিন্তু ভূখণ্ডটির মাত্র কিছু অংশ তারা নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে, পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ দুটি ওই অঞ্চল নিয়ে দুটি যুদ্ধ করেছে। ১৯৮০’র দশকের শেষের দিক থেকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
যদিও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বছরের পর বছর ধরে প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে। তবুও কাশ্মীরের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা দিল্লির প্রশাসনকে অবিশ্বাসের চোখে দেখেন। ২০১৯ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে ফেডারেল সরকার যখন এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়, তখন থেকে সেই অনুভূতি আরও মজবুত হয়। তাই কিছু স্থানীয় মানুষ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, ফ্যাশন শো’র ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখে তারা অবাক হননি।
কাশ্মীরের সবকিছুই রাজনৈতিক; মানুষ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। পরিচয় গোপন রাখতে অনুরোধ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ফ্যাশন শোয়ের মতো বড় কর্পোরেট ইভেন্টগুলোকে মানুষ সন্দেহ করে। এমনকি যদি সেগুলো ব্যক্তিগত উদ্যোগেও আয়োজন করা হয়। মানুষ বিশ্বাস করে, সরকার তাদের সংস্কৃতিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
আরশিদ আহমেদ নামে একজন গবেষক জনসাধারণের ক্ষোভ বোঝাতে আরও কড়া শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার কাশ্মীরিদের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনাকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
স্থানীয় নন এমন আয়োজকদের কোনো অনুষ্ঠান কাশ্মীরে বিতর্ক জন্ম দিয়েছে, এমনটি এই প্রথম ঘটনা নয়। ২০১৩ সালে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মানবাধিকার কর্মীরা বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক জুবিন মেহতার একটি অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন যে, কাশ্মীরে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, বাকি পৃথিবীকে এমনটিই দেখানোর জন্য অনুষ্ঠানটি ভারত সরকারের একটি চেষ্টা ছিল। কিন্তু তখন সেখানকার মানুষ ‘দুর্ভোগে আক্রান্ত হচ্ছিল ও মারা যাচ্ছিল’।
ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে কাশ্মীরে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার ফলেও সেখানকার সংস্কৃতি এবং পরিচয় নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু আশঙ্কার কথা উঠেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়ই পর্যটনের এই বেড়ে যাওয়াকে ৩৭০ ধারা বাতিলের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছে। ধারাটি বাতিলের মাধ্যমে অঞ্চলটির স্বায়ত্তশাসনও বাতিল করা হয়েছিল।
৩৪ বছর বয়সী নওশীন ফাতিমা বলেছেন, সরকারের বার্তার কারণে কাশ্মীরের বাইরের লোকেরা এখন অঞ্চলটিকে নিরাপদ এবং ‘ভারতের সঙ্গে আরও বেশি একীভূত’ বলে মনে করে। তিনি অভিযোগ করেন, অনেক পর্যটক অঞ্চলটির সংস্কৃতিকে সম্মান করেন না।
গত বছর শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাল হ্রদে নৌকা ভ্রমণের সময় পর্যটকদের মদ্যপান করার একটি ভিডিও রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ক্ষোভের জন্ম দেয়। সেই নেতারা এমন আচরণকে ‘অনৈসলামিক এবং অনৈতিক’ বলেন। ফেব্রুয়ারিতে, স্থানীয়রা শ্রীনগরে পোস্টার লাগিয়ে পর্যটকদের ‘স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে সম্মান করতে’ এবং ‘মদ্যপান এবং মাদকের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে’ অনুরোধ করে। কিন্তু পরে পুলিশ পোস্টারগুলো সরিয়ে দেয়।
‘দ্য ভয়েস অফ ফ্যাশন ম্যাগাজিনের’ একটি সম্পাদকীয়তে শেফালি বাসুদেব যুক্তি দেন, এমন ক্ষোভকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা করা দরকার। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কাশ্মীরের পরিবর্তে ভারতের অন্য কোনো শহরে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা কি ঠিক হতো? সেখানেও মুসলমানরা রমজান পালন করত। আর যদি কেবল শালীন পোশাকই থাকত, তাহলে কাশ্মীরে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা কি গ্রহণযোগ্য হতো?
শেফালি বাসুদেব মনে করিয়ে দেন, কাশ্মীরে পৃথিবীর সেরা উলের সুতা তৈরি হয়। অন্যতম সেরা হাতে তৈরি, হাতে বোনা পশমিনা এবং এর কারিগরদের আবাসস্থল ওই কাশ্মীর। তিনি আরও বলেছেন, কাশ্মীরে যা তৈরি হয়, তা আর কোথাও তৈরি করা যায় না। তাহলে গুলমার্গে শতভাগ পশমের তৈরি নতুন পোশাক দিয়ে আয়োজন করা ফ্যাশন শোকে কি অপ্রচলিত উপায়ে কাশ্মীরের ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ জাগানোর চেষ্টা হিসেবে দেখা উচিত কিনা, তিনি সেই প্রশ্ন রেখেছেন।
উল্লেখ্য, সাধু ও সুফিবাদের স্থান হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর আধ্যাত্মিকতার এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ধারণ করে আছে, যা মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। স্থানীয় নারী ও পুরুষ উভয়ই প্রায়শই ‘ফেরান’ নামের ঐতিহ্যবাহী একটি দীর্ঘ, ঢিলেঢালা, শালীন পোশাক পরেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
এমএইচডি/এমজে