ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দৌলতপুরে ১০ হাজার টাকার সরকারি নলকূপ ২৫ হাজার টাকা!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২৩
দৌলতপুরে ১০ হাজার টাকার সরকারি নলকূপ ২৫ হাজার টাকা!

মানিকগঞ্জ: সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পটির অধীনে গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মানিকগঞ্জ জেলার সাতটি উপজেলায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কাছ শুরু করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।  

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নলকূপ বসানোর আগে থেকেই জামানতের নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নিচ্ছে চিহ্নিত দালাল চক্রের মাধ্যমে।

 

আর এর জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে দৌলতপুর উপজেলার মেকানিক প্রদীপ কুমার ও উপ-সহকারী রিদওয়ান আহমেদকে।  

গভীর নলকূপ বসানো নিয়ে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা এ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন।  

মানিকগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী গাজী ফাতেমা ফেরদৌসের অধীনে উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে এ গভীর নলকূপগুলো স্থাপনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়,  স্থানীয় সংসদ সদস্য,  উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশে দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলায় মোট ১২৬ গভীর নলকূপ বসানোর কাজ চলছে। চলতি অর্থবছরে ১৮টির মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় আটটি গভীর নলকূপ বসানো শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে। প্রতিটি গভীর নলকূপের জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

জেলার দৌলতপুর উপজেলার কলিয়া ইউনিয়নের বেকুয়াইল,  তালুকনগর, হাটাইল, ধামশ্বর ইউনিয়নের আন্দিবাড়ী, বিল পাউলী, নিরালী, পূর্ব তেহারী, চকমিরপুর ইউনিয়নে এ প্রকল্পে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

গভীর নলকূপ স্থাপনে সরকার নির্ধারিত ফি ১০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে চালান জমা দিতে হয়। কিন্তু জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশ কিছু চিহ্নিত দালালের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পে একটি নলকূপ থেকে আটটি বাড়িতে সংযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও সংযোগ দেওয়া হয়েছে একটি মাত্র বাড়িতে। যারা এ প্রকল্পটির গভীর নলকূপ নিয়েছেন, তারা জানেনই না যে আরও বেশ কয়েকটি বাড়িতে এ পানির লাইন যাবে। আবার অনেকে নিজেদের বাড়ির অন্য সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে একাই নলকূপের সুবিধা নিচ্ছেন। বেশ কয়েকটি বাড়িতে নলকূপ বসানো হলেও দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় বাকি উপকরণ। উপজেলা দৌলতপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মেকানিক প্রদীপ কুমার ও উপ-সহকারী রিদওয়ান আহমেদ দালাল চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চক্রটি প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ সাহস পায় না প্রতিবাদ করার।

উপজেলার কলিয়া ইউনিয়নের বেকুয়াইল এলাকার দিনমজুর রবি খান বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে পানির কষ্টে ছিলাম,  পরে পাশের ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার রবি মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে বলেন, কিছু টাকা খরচ করতে পারলে নলকূপ পাওয়া যাবে। প্রথমে আমি তাকে ১৪ হাজার টাকা দিই, পরে আরও ১০ হাজার টাকা দিই। পরের টাকা দেওয়ার সময় আমি তাকে বলি, এ টাকা দিয়ে কী হবে। রবি মেম্বার আমাকে বলেন, অফিসে প্রদীপ বাবু নামের এক লোক আছেন, তাকে দিতে হবে। প্রদীপ বাবু অফিসের বড় স্যারকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করবেন, তা না হলে তোর নলকূপ আটকে যাবে। আমি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাই, আমার কাছে এতো টাকা ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে সুদে টাকা তুলে তাকে দিই। যতবার অফিস (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর) থেকে লোকজন আসছে, ততবারই হাজার কিংবা হাজারের ওপরে টাকা বকশিশ দিতে হয়েছে আমাকে।  

একই ইউনিয়নের হাটাইল এলাকার সৌদি প্রবাসী লিয়াকত হোসেন বলেন, আমি ছুটিতে আসার পর আমার বাড়ির পাশের এক ভাতিজা বলে, কাকা আমি আপনাকে একটি নলকূপ এনে দেই? তখন আমি রাজি হলে সে আমাকে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে নিয়ে যায়। অফিসে প্রদীপ নামে এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ওই দিন আমার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেয়। ব্যাংকে ১০ হাজার টাকা জমা দিতে দেখে বলি, টাকা নিলেন ৩০ হাজার আর জমা দিলেন ১০ হাজার টাকা, কারণ কী? প্রশ্ন শুনে ভাতিজা ও প্রদীপ বলেন, অন্য একজনের নাম কেটে আপনার নাম তালিকায় দিলাম। ওই ভাতিজা বলে, দেখেন কাকা ওনার কত ক্ষমতা আর টাকাটা শুধু তিনি (প্রদীপ) একাই নেবেন না, তার যে বস আছে, তাকেও তো দিতে হবে। উপজেলা থেকে বাড়ি এসে দেখি নলকূপের মালপত্র আমার বাড়িতে চলে এসেছে। পাইপ স্থাপন করার পর জানতে পারি, এ নলকূপ থেকে আরও কয়েক বাড়িতে সংযোগ যাবে। যখন অন্য বাড়ির লোকজন পানির সংযোগ নিতে রাজি না হয়, তখন ওই বাকি সংযোগের জন্য আমার বাড়ির অন্য সদস্যদের এনআইডি কার্ডের কপি ও আরও ১২ হাজার টাকা দিই তাদের। আমি এতো টাকা পয়সা দেওয়ার পরও এখনও বাকি উপকরণ পাইনি।

ধামশ্বর ইউনিয়নের নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক চিহ্নিত দালাল চক্র আছে, যাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করে নেওয়া হয়। অফিসে প্রদীপ নামে এক স্টাফ আছেন, সব দালালের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। প্রদীপতো আর একা এ টাকা খান না, তার সঙ্গে দৌলতপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী রিদওয়ান আহমেদও জড়িত।

দৌলতপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিশ্বস্ত দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে সংবাদকর্মীর পরিচয় পাওয়ার পর অনেকেই ফোন কেটে দেন আবার ব্যস্ত অজুহাতে অন্যত্র সটকে পড়েন অনেকে।

নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দৌলতপুর কার্যালয়ের এক কর্মী বলেন,  অফিসের ভেতরে ও বাইরে কী হয়, তা আমরা কেউ বলতে পারব না। তবে সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় উপ-সহকারী রিদওয়ান আহমেদের ইশারায়। ওনার ইশারার ওপর নির্ভর করে প্রদীপ কুমার সব কাজ করে থাকেন।

অভিযুক্ত প্রদীপ কুমারকে অফিসে পাওয়া না গেলেও ফোনে তিনি বলেন, যা হওয়ার তাই হয়েছে, আপনি এখন কোথায় আছেন বলেন, অফিস থেকে আমার লোক দেখা করবে আপনার সঙ্গে।  

কেন দেখা করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুল যা করার করে ফেলেছি, এখন মিষ্টি খাওয়ার টাকা নিয়ে চলে যান। দেখা না করলে আপনার মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর দেন, ওইখানে দিয়ে দিচ্ছি।  

তবে এতে প্রতিবেদকের কোনো সাড়া না পেয়ে পরে দালাল চক্রের একজন ফোন দিয়ে দেখা করতে চান প্রতিবেদকের সঙ্গে।  

চিহ্নিত দালাল চক্রটি প্রতিবেদককে কোনোভাবে ম্যানেজ করতে না পেরে বিভিন্ন মানুষকে দিয়ে নিউজ না করার জন্য তদবির করতে শুরু করে।

দৌলতপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রিদওয়ানের বক্তব্য নেওয়ার জন্য কয়েকদিন গিয়েও অফিসে তার দেখা মেলেনি।  

পরে ফোনে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ এ ধরনের অপরাধ করে থাকলে এর দায়ভার তাকেই নিতে হবে।

মানিকগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী গাজী ফাতেমা ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, এ ব্যাপারে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে আমি জানি না। খোঁজ খবর নিচ্ছি। অভিযোগের সত্যতা পেলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।