চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে: শৃঙ্খলাই সৈনিকের মূলভিত্তি উল্লেখ করে নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান বলেছেন, আদেশ ও কর্তব্য পালনে যে কখনো পিছপা হয় না সেই প্রকৃত সৈনিক, বীরযোদ্ধা। সততা-কর্তব্যনিষ্ঠা, আনুগত্য-নির্ভরযোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা-কর্মতৎপরতা, তেজ-উদ্দীপনা একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতার মাপকাঠি।
মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে অবস্থিত বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজে (বিজিটিসিএন্ডসি) বিজিবির ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বছর বাহিনীতে সীমান্ত রক্ষার শপথ নিয়েছেন ৩৮ জন নারীসহ ৫৮২ জন নবীন সৈনিক। নবীন সৈনিকদের প্রদর্শিত তেজোদীপ্ত কুচকাওয়াজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন বিজিবির মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, সততা, আনুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা- এ চারটি গুণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ‘সবার আগে দেশ, এরপর বাহিনীর স্বার্থ, অতঃপর অধীনস্থ ও সহকর্মীদের স্বার্থ এবং সর্বশেষে নিজের স্বার্থ’কে বিবেচনায় রেখে সবাইকে কাজ করতে হবে।
বিজিবির ডিজি বলেন, নবীন সৈনিকরা এসব গুণাবলির প্রতিফলন ঘটিয়ে বাহিনীর ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবে বলে আমি আশা করছি। বিজিবির চারটি মূলনীতি- ‘মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা’য় উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত হয়ে বিজিবির ওপর অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব সুশৃঙ্খল ও সুচারুরূপে পালন করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর বাহিনীর তৃতীয় ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আজ আপনাদের কাছে আমি অনেক বড় কর্তব্য দিয়েছি, অনেক বড় কাজ দিয়েছি। এ কাজ হলো- চোরাচালানি বন্ধ করা। তোমাদের কাছে আমার হুকুম- স্মাগলিং বন্ধ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা পারবা। ’ জাতির পিতা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের বিদায়লগ্নে নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যারা নতুন আজ বিডিআরে যোগদান করেছো, যারা শপথ গ্রহণ করলা, তাদের কাছে আমার কথা রইলো- ইমানের সঙ্গে কাজ করো, সৎ পথে থেকো, দেশকে ভালোবাসো। ’
জাতির পিতার এ চোরাচালানবিরোধী ও প্রেরণামূলক অমূল্য কথাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে সীমান্তে চোরাচালান রোধসহ পেশাগত দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান বিজিবি মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়- একটি উন্নয়নশীল দেশ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি স্বপ্নের প্রকল্পসমূহ আজ দৃশ্যমান। বাংলাদেশ আজ স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে হাঁটছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশিত উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজিবির প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে বলে বিজিবির মহাপরিচালক আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, কিংবদন্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এ বাহিনী সাফল্যের পথ পরিক্রমায় আজ একটি সুসংগঠিত, চৌকস, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিজিবি ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচাররোধ, নারী ও শিশু পাচারসহ যেকোনো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে দক্ষতার সাক্ষর রেখে চলেছে। স্বাধীনতার পর দেশ গঠন এবং দেশ মাতৃকার সেবায় এ বাহিনীর সদস্যরা গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো দুর্যোগময় মুহূর্তে জনগণের সেবায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে বিশ্বস্ততা-সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বিজিবি আজ সবার আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহ পৃষ্ঠপোষকতা ও দূরদর্শী দিক-নির্দেশনায় বিজিবি আজ একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও অত্যাধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বিজিবি দিবস-২০১৯ এর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতির পিতার হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠান আগামীতে সারা বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে মর্যাদা অর্জন করবে- সে বিশ্বাস আমার আছে। ’
প্রধানমন্ত্রীর এ প্রত্যাশা বিজিবির আধুনিকায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে উল্লেখ করে এ কে এম নাজমুল হাসান বলেন, উন্নয়নের ক্রমধারায় বিজিবির সাংগঠনিক কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং বিজিবি আজ ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে জল, স্থল ও আকাশপথে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। বিজিবিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার, এপিসি, এটিভি, আরসিভি, এয়ার বোট, অত্যাধুনিক এন্টি ট্যাংক অস্ত্র, জলযানসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি। ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজিবির রিক্রুটিং ব্যবস্থাকে ই-রিক্রুটিংয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিওপিসমূহকে যোগাযোগের আওতায় আনা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ৭৩টি আধুনিক কম্পোজিট বিওপি। দৃষ্টিনন্দন নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নের মতো আরও নতুন নতুন ব্যাটালিয়নের প্রকল্প চলমান রয়েছে। ক্যাপাসিটি ম্যাক্স এবং রিপিটারের মাধ্যমে সারা দেশে বিজিবির যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অভিযানিক দায়িত্ব পালনে বিজিবি সদস্যদের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ নতুন নতুন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে কুমিল্লায় বর্ডার গার্ড স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স এবং খুলনায় বর্ডার গার্ড টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান বিজিবি বাহিনীর প্রশিক্ষণ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চুয়াডাঙ্গায় আরও একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্বলিত ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বিজিবির ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত রয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০২৩
এসজেএ/আরবি