ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

বর্জ্যে বিষাক্ত ঢাকার ৪ নদী

নিখিল ভদ্র, সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৮:৪৩, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫
বর্জ্যে বিষাক্ত ঢাকার ৪ নদী ছবি: সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকার চারপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদ-নদীর পানিতে প্রতিদিন মিশছে ৮০ হাজার কিউবিক মিটার তরল বর্জ্য। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে এই দূষণ বাড়ছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকার এই চারটি নদ-নদী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদী দূষণে-দখলে বিপন্নতার মুখে রয়েছে।

এ অবস্থায় আজ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালিত হয়। দিবসটি উপলক্ষে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘আমাদের নদী, আমাদের অস্থিত্ব’।

নদী আমাদের অস্থিত্বের সঙ্গে জড়িত হলেও অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্ব এখন সংকটে রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি নদীর একটি হলো ঢাকার বুড়িগঙ্গা। এই নদীর পানিতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু রয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাট এলাকায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ০.২৪ মিলিগ্রাম।

অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০০৭ অনুযায়ী মৎস্য ও জলজ প্রাণীর জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রয়োজন পাঁচ মিলিগ্রাম বা তার বেশি। বুড়িগঙ্গার মতো শীতলক্ষ্যা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদী প্রতিদিন মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। এই দূষণে নদীর পানি তার স্বাভাবিক রং হারিয়ে ফেলেছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাত হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নিজস্ব ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই।

এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন নদীর পানিতে মিশ্রিত তরল বর্জ্যের পরিমাণ ৮০ হাজার কিউবিক মিটার। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর ২৫৮টি পয়েন্ট দিয়ে গৃহস্থালি পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। তুরাগ নদের ২৬৯টি, বালু নদের ১০৪টি ও টঙ্গী খালের ৬২টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য নিঃসরণ হচ্ছে। এ ছাড়া লোকালয় থেকে প্রতিদিন সৃষ্ট আবর্জনার পরিমাণ ৪৫ হাজার টন, যার ৮০ শতাংশ মিশছে নদীর পানিতে। বুড়িগঙ্গায় প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার যান্ত্রিক নৌযান চলাচল করে। এসব যানবাহনের সব ধরনের বর্জ্যের শেষ ঠিকানা বুড়িগঙ্গা। এই নদীতে জাহাজ মেরামত কারখানার বর্জ্য ফেলা হয়। নদীপারের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করে নদীতীরে বনায়ন, সৌন্দর্য বর্ধন, পার্ক নির্মাণ, সীমানা পিলার নির্মাণের মতো কাজের নামে বিপুল অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। নদী বাঁচাতে অভিযান চালিয়েও আটকানো যাচ্ছে না দখলদারদের। নদী রক্ষায় সীমানা পিলার নির্মাণ হলেও এর ভেতরেই গড়ে উঠেছে স্থাপনা। নদীর জায়গায় কেউ কারখানা, কেউ বসতঘর, আবার কেউ ধর্মীয় স্থাপনা বানিয়েও চালাচ্ছেন দখলদারি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১৯ সালে ঐতিহাসিক এক রায়ে নদীকে ‘জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন’ অর্থাৎ জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। দেশের সব নদী দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা সরানোর নির্দেশনাও দেন আদালত। পুরো কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নদীরক্ষা কমিশন কার্যত অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। কচ্ছপগতিতে চলা সংস্থাটি দখলদারদের পক্ষেও ভূমিকা নিচ্ছে। দখল, দূষণ, নদী থেকে বালু উত্তোলনে দেশের প্রায় সব নদী টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় ৫৭ হাজার ৩৯০টি অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ১৮ হাজার ৫৭৯ জন বা ৩২ শতাংশ অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়। এরপর উচ্ছেদ কার্যক্রম থমকে যায়। পরে প্রভাবশালীরা আবারও দখলমুক্ত অনেক জমি দখল করে নিয়েছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নদী দখলদারদের উচ্ছেদ ও দূষণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নদী রক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদী রক্ষা না করলে যতই উন্নয়ন করি, তা টেকসই হবে না। নদীদূষণ সম্পর্কে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হতে হবে। নতুন প্রজন্মকে নদী সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নদীকে রক্ষা করতে হবে।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নদ-নদী বাঁচাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। আমরা নদী বাঁচানোর একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আসলে অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমরা ঢাকাকে ঘিরে থাকা চারটি নদীকে দূষণমুক্ত করার কাজ হাতে নিতে পারিনি। আমরা এখন শুধু তুরাগকে দূষণমুক্ত করার কাজ শুরু করেছি। ’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে এখনো নদী দখল ও দূষণ চলছে। গণ-অভ্যুত্থানের মাধমে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবার প্রত্যাশা ছিল, এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা আসেনি। সরকার দেশের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে নদী সংস্কার কমিটি করতে পারত। আরেকটি সহজ কাজ ছিল জাতিসংঘের ১৯৯৬ সালের আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করা। সেটাও আটকে আছে।

আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।