ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ চৈত্র ১৪৩১, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ইউসুফের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু ৪ ফেব্রুয়ারি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
ইউসুফের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু ৪ ফেব্রুয়ারি

ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে ইউসুফের পক্ষে আসামিপক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ।

৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনজন সাক্ষী সাফাই সাক্ষ্য দেবেন।
 
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রাষ্ট্রপক্ষের ২৭তম এবং শেষ সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিনের জেরা সম্পন্ন হয়। ইউসুফের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন। এ সময় প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা, জাহিদ ইমাম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন একেএম ইউসুফ।

জেরা শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দেওয়া ৫৬ জন সাফাই সাক্ষীর তালিকা থেকে তিনজন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার অনুমতি দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি আসামিপক্ষের এসব সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৪, ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করে দেন।
বিচারিক কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনাল আসামি একেএম ইউসুফকে আসামির কাঠগড়া থেকে নামিয়ে সামনে এনে কথা বলেন। ট্রাইব্যুনাল ইউসুফকে বলেন, শীত এবং ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে আপনার উকিল সাহেবরা দরখাস্ত করেছিলেন যেন, আপনাকে সব দিন (ট্রাইব্যুনালে) না আসতে হয়। এখনতো শীত কমেছে, আপনাকে সব দিন আসতে হবে।
 
উত্তরে ইউসুফ বলেন, সব দিন না এলে ভালো হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ঠিক আছে, আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি আসেন, কোনো অসুবিধা হলে পরে আমরা বিবেচনা করবো।  
 
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ইউসুফ সাহেব, একটি বিষয় জানার জন্য আপনাকে ডেকেছি। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বরের আগে মালেক মন্ত্রিসভা থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন? এবং পদত্যাগের পর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে (বর্তমান রুপসী বাংলা) আশ্রয় নিয়েছিলেন কেন? কেন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না? উত্তরে ইউসুফ আমতা আমতা করে বলেন, পরিস্থিতির কারণে।
 
ট্রাইব্যুনাল আবারো জিজ্ঞেস করেন, আপনি এ মন্ত্রিসভার কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন? ইউসুফ বলেন, রাজস্ব এবং ওয়াপদা।
 
ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, মালেক সাহেব কি ডেন্টিস্ট ছিলেন? ইউসুফ বলেন, উনি ডেন্টিস্ট ছিলেন নাকি চোখের ডাক্তার ছিলেন ঠিক মনে নেই। তবে তিনি এর আগেও মন্ত্রী ছিলেন এবং শ্রমিক আন্দোলন করেছেন।    
 
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদের আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে ডা. মালেক প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দু’জন সদস্য ছিলেন। তাদের একজন এই ইউসুফ ছিলেন রাজস্ব, পূর্ত, বিদ্যুৎ ও সেচ মন্ত্রী। অপরজন জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আব্বাস আলী খান বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা দু’জনসহ ওই মন্ত্রিসভার সব সদস্য গ্রেফতার হন।
 
গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ইউসুফের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আরো ২৬ জন সাক্ষী। তাদের মধ্যে ঘটনার সাক্ষীরা হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা মো. লিয়াকত আলী খান, মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন আহমেদ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মজিদের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল আলম জাহাঙ্গীর, মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউসুফ আলী, শহীদ পরিবারের সদস্য আব্দুল জলিল টুনু, শহীদ পরিবারের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক ও তার মা আসিয়া খাতুন, মুক্তিযোদ্ধা এম এ খালেক, মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুর রউফ মল্লিক, পিযুস কান্তি ঘড়াই, শহীদ শান্তি রঞ্জন দাশের স্ত্রী মুকুল রাণী দাশ, মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবজাল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা শুধাংশু মণ্ডল, বাবুল মিস্ত্রি, সুনিল কুমার ডাকুয়া, মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান নকীব, তৈয়ব আলী খা ছেতু, মুক্তিযোদ্ধা শিকদার হাবিবুর রহমান, আব্দুল লতিফ হাওলাদার, মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ দাশ, বিজয় কৃষ্ণ দাশ, দুলাল কৃষ্ণ দাশ, বরুণ দাশ এবং শহীদ জায়া উল্লাসিনী দাশ। আর জব্দ তালিকার সাক্ষী হচ্ছেন বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) ক্যাটালগার রবিউল আনাম খান। তাদের জেরা করেছেন আসামিপক্ষ।

গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউটর  রেজাউর রহমান ইউসুফের বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন।

এর আগে ১ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এ কে এম ইউসুফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের এই নেতাকে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ ৪ ধরনের ১৩টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার ৫টি, গণহত্যার ৭টি এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ১টি অভিযোগ রয়েছে।

প্রায় ৭০০ জনকে হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন এই জামায়াত নেতা। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ৩০০ বাড়ি ও ৪০০ দোকান লুটের অভিযোগ করা হয়েছে।
 
ইউসুফের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ, পরামর্শ ও প্ররোচনায় খুলনার বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ সংঘটিত হয় বলে তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগও।
 
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে পাকিস্তানিদের গঠিত কথিত মালেক সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ইউসুফ। অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হত্যা-লুণ্ঠনে সহায়তা দেওয়ার জন্য গঠিত সশস্ত্র বাহিনীর ‘রাজাকার’ নামটি তিনিই চালু করেন।
 
সেই সময় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নির্দেশে এ কে এম ইউসুফ নিজে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে বৃহত্তর খুলনা জেলায় (খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট) শান্তি কমিটি গঠন করেন। পরে মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে জামায়াত ও মুসলিম লীগের সদস্যরাসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করেন তিনি।
 
বিভিন্ন এলাকা থেকে ৯৬ জনকে নিয়ে তিনি খুলনার আনসার ও ভিডিপি ক্যাম্পে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। ওই অঞ্চলের শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতৃত্ব দেন।
 
জামায়াতের উচ্চ পর্যায়ের নেতা, বৃহত্তর খুলনার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও মন্ত্রী হিসেবে ইউসুফ পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
 
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আইনটি বাতিল হলে পরে তিনি মুক্তি পেয়ে যান। এক সময় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্বও পালন করেছেন। বর্তমানে দলের নায়েবে আমির তিনি।
 
এর আগে গত বছরের ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা। ২৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন একেএম ইউসুফের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
 
১২ মে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নিয়ে ইউসুফের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই ধানমণ্ডির বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করেন র্যাব সদস্যরা।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ১৫টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। ৮ মে এ অভিযোগ জমা দেন প্রসিকিউশন।
 
জামায়াতের এ নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি অভিযোগে তদন্ত চূড়ান্ত করে গত বছরের ২২ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর বরাবর প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।