ঢাকা, সোমবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

‘ডর নাই, আল্লাহ নিলে নিবো গা’

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৮, ২০১৫
‘ডর নাই, আল্লাহ নিলে নিবো গা’ ছবি: বাংলানিউজেটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: সাথীর (৩০) বাবা নেই। স্বামী থেকেও নেই।

বাঁশ আর পলিথিনে মোড়ানো তিন হাতের ছোট্ট একটি খুপড়ি ঘরে থাকেন মা আর তিন সন্তান নিয়ে। প্রায় এক যুগ ধরে বসবাস করছেন রেললাইন ঘেঁষেই বিপজ্জনকভাবে গড়ে ওঠা বস্তিতে।

নগরের অলি-গলি ঘুরে প্লাস্টিকের বোতলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কুড়িয়ে ভাঙ্গারি দোকানে বিক্রি করে চালান পাঁচ সদস্যের ভারী সংসার। প্রতিনিয়ত ট্রেনের কু-ঝিকঝিক শব্দে চাপা পড়ে তাদের জীবনের কোলাহল। দূর থেকে রেললাইনের মায়াময় আলো ছড়ানো বাতিগুলো তাদের জীবনকে রাঙিয়ে তোলে না। অর্ধাহার-অনাহারে কাটে দিন। জীবন তার কাছে এক নরক যন্ত্রণার নাম।

রেললাইনের ধারের বস্তিতেই জন্মেছেন ফাতেমা আক্তার মনা। বয়স বাইশের কোঠায়। একজনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেও টেকেনি সেই সংসার।

আবারো ফিরে আসতে হয়েছে বস্তিতেই। একমাত্র সন্তানের মুখে আহার জোগাতেই পাশের চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছেন। নানা রোগ-ব্যাধি তাদের জীবনকে করে তুলছে আরও দুঃসহ। তার কাছেও জীবনের অর্থ শুধুই যন্ত্রণার।

শুধু সাথী বা মনাই নন, ময়মনসিংহ শহরের নাটকঘর লেন এলাকার রেললাইন ঘেঁষে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠা বস্তিতে বসতি গড়েছেন আরও ২০ পরিবারের কমপক্ষে শতাধিক ছিন্নমূল মানুষ।

নিরুপায় হয়ে বিনা ভাড়ার এ খুপড়ি ঘরে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও দুর্ভোগেরও শেষ নেই। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক বিষয়গুলোও তাদের জীবন থেকে নির্বাসিত।

শুক্রবার (০৬ নভেম্বর) রাত ১১টার দিকে বস্তিতে গেলে কথা হয় ফাতেমা আক্তার মনা, সাথী আক্তার, হাসি ও সালেহাদের মতো বিপন্ন মানুষদের সঙ্গে।

দেখা গেলো, কারও কারও খুপড়ি ঘরের সামনে চুলো জ্বলছে। ক্ষুধাতুর শিশুরা মা-নানিদের পাশে বসে অপেক্ষায় রয়েছে আহারের আশায়। আহার জুটলে তবেই নিশ্চিন্ত মনে ঘুম।

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গড়া ওঠা এ বস্তিতে গোসলের জায়গা নেই। বিশুদ্ধ খাবারের পানি নেই। উল্টো পুষ্টিহীনতা, চর্মরোগ, পেটের পীড়াসহ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত বস্তিবাসীরা।

নাম হাসি হলেও মুখ থেকে হাসি উবে গেছে হাসি বেগমের (৬০)। স্বামী ভ্যানগাড়ি চালক। সংসারে দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। ২০ বছর ধরে বাস করছেন এ বস্তিতে। রেললাইন বিপজ্জনক পথ। এখানে বসতি গড়া মানে, যেকোনো সময় মৃত্যু। কিন্তু এটিই তাদের জীবন বাস্তবতা।

হাসির বলেন, আমগোর (আমাদের) তো জায়গা, সম্পদ নাই। বাসা-বাড়িত থাকবারও সামর্থ্য নাই। ডাস্টবিন থেইক্যা কাঁচের বোতল, প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা আয়না, কার্টুনের বক্স আর জুতার বাক্স কুড়িয়েই কোনোমতে সংসার চালাই। ’

পাশেই দাঁড়ানো ফাতেমা আক্তার মনা। মৃত্যুর ভয়াবহতা নিয়ে শঙ্কিত নন। বললেন, আমগোর জীবনের কোনো দাম নাই। জীবন লইয়া ডরও নাই। আল্লাহ নিলে নিবো গা। তবে ডর হয় পোলাপানডির লেইগ্যা (জন্য)।

দারিদ্র্যের অন্ধকারে জন্ম নেওয়া এ বস্তির শিশুদের জন্য নেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের কোনো ব্যবস্থা। কোনো এনজিও এগিয়ে আসে না তাদের জন্য। যে বয়সে তাদের হাতে খাতা-কলম থাকার কথা সেই বয়সে অনেক শিশু লেগে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। পাশাপাশি পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তারা।

মনা বলে ওঠেন, জন্মের পর আমগোর পোলাপান ট্রেনের শব্দ আগে পায়। লেহাপড়া ওগোর কপালে নাই। আমগোর মতো ওরা মুরুক্ক (মূর্খ)।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এ বস্তি অপরাধীদের অভয়ারণ্য। এখানে চলে মাদক বিক্রিসহ অসামাজিক কার্যকলাপ। রেললাইন ঘেঁষেই বস্তিবাসীরা বানিয়েছেন কাঁচা-খোলা টয়লেট। এসব টয়লেটের দুর্গন্ধে স্থানীয় পথচারী এমনকি ট্রেন যাত্রীদেরও দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। এ পয়েন্ট দিয়ে যাওয়ার সময় নাক চেপে পার হতে হয় ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০8, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।