মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্যি, ধূপ, ধুনো আর কর্পূরের গন্ধ, অঞ্জলি, সন্ধিপূজো চলবে ক’দিন পরেই। তাই পূজো এলেই মনের ভেতরটা হৈহৈ করে ওঠে।
এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রাজশাহীর আলুপট্টি এলাকার পাল বাড়িতে গেলে খুব সহজেই অনুভবিত হচ্ছে সেই উৎসবের হাওয়া।
নরম কাদা-মাটি দিয়ে শৈল্পিক ছোঁয়ায় তিল তিল করে গড়ে তোলা দশভুজা দেবী দুর্গার প্রতিমায় এখন ভরে উঠেছে কার্তিক চন্দ্র পালের বাড়ি। আসছে মধ্য অক্টোবরেই দেবীর বোধন। তাই পালবাড়ির চারিদিকেই এখন ব্যস্তার ছাপ।
প্রতিমা তৈরির পর পরই তা রূপায়নের কাজ শুরু হবে। নানান রঙ আর তুলির আঁচরে ফুটিয়ে তোলা হবে দেবীর প্রতিচ্ছবি। তাই যেনো ঘুম নেই পাল বাড়িতে। প্রাপ্তিযোগের আশায় মনের আনন্দে কাজের ছন্দে চলছে পার্বণের জোর প্রস্তুতি।
কার্তিক চন্দ্র পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জোরেশোরেই চলছে দুর্গা প্রতীমা তৈরির কাজ। প্রধানত, রাজশাহী শহরের বেশিরভাগ এলাকার পূজা মণ্ডপই সাজে পাল বাড়ির এই প্রতিমায়। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেন এখানকার প্রতিমা শিল্পীরা। হাতের নিপুণ কারিগরিতে ৩০ থেকে ৪০টি প্রতিমা গড়ে তোলা হয়। প্রতিমার সাজ-সজ্জা শেষে তুলে দেওয়া হয় বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে।
বংশ পরম্পরায় এ পেশা পেয়েছেন বলে জানান প্রতিমা শিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল। বাবা বাবু চন্দ্র পাল তার শৈল্পিক হাতে প্রতিমা তৈরি করতেন। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এগুলো দেখেই তার বেড়ে ওঠা। প্রতিমা তৈরির নেশা তাকে বই-পত্রে মন বসাতে দেয়নি। তাই মাত্র দশ বছর বয়সেই দীক্ষা নেন বাবার কাছে। বাবার কাছেই শেখেন কাদা-মাটি আর কাঠ-খড় দিয়ে কিভাবে প্রতিমা গড়া।
এক প্রশ্নের জবাবে কার্তিক জানান, গেলো ২৭ বছর থেকে তিনি প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। তার কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিমার ক্যাটালগ আছে। তা দেখেই দুর্গাপূজা শুরুর অন্তত দু’মাস আগে প্রতিমা তৈরির অর্ডার দিয়ে যান রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
ক্যাটালগ অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিমা তৈরি করেন তিনি।
আর দুর্গাপূজা শুরুর অন্তত আড়াই মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেন। পূজা শুরুর ২/৪ দিন আগে তা সরবরাহ করেন। তবে কেউ চাইলে এক সপ্তাহ আগেও নিয়ে যেতে পারেন। তার অধীনে এখন মোট পাঁচজন কারিগর কাজ করছেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজ শেষ করাই সবার লক্ষ্য। যে কারণে এখন কথা বলার ফুরসত নেই পালবাড়ির প্রতিমা কারিগরদের। জেলার চারঘাট উপজেলার সরদহ থেকে প্রতিমা তৈরির মাটি কিনতে হয়। তবে মাটির চেয়ে পরিবহনের খরচই বেশি। এক ট্রাক মাটির দাম আট থেকে নয় হাজার টাকা। কিন্তু তা আনতে গাড়ি ভাড়া লাগে আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা।
এছাড়া প্রতিমা সাজানো চুল বর্তমানে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা কেজি। এর সঙ্গে রঙ, শাড়িসহ অন্যান্য সাজ-সজ্জার উপকরণ রয়েছে। সব মিলিয়ে যা খরচ হয় তার চেয়ে খুব একটা লাভ হয় না। এরপরও পৈত্রিক পেশা টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে চলেছেন প্রতিমা শিল্পী কার্তিক চন্দ্র পালরা।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, আষাঢ়ের নয় তারিখ থেকে তারা প্রতিমা তৈরি শুরু করেছেন। প্রতিমা গড়ার কাজ মাঝ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতিমাগুলোর নকশা ঠিক করা হচ্ছে। আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই দুর্গা প্রতিমাগুলোয় চূড়ান্ত রঙ লাগিয়ে পোশাক পরিচ্ছদে সুসজ্জিত করা হবে। তারপর থেকেই বিভিন্ন মণ্ডপে পাঠানো হবে।
মহানগরীর কুমারপাড়া এলাকার অপর প্রতিমা শিল্পী গণেশ চন্দ্র পাল জানান, তিন মাস আগে দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরির অর্ডার পান এবং কাজও শুরু করেন। এখনও অনেকে আসছেন। তবে এখন আর অর্ডার নেওয়া হচ্ছে না। যে প্রতিমাগুলোর কাজ শুরু হয়েছে। সেগুলোরই কাজ চলছে। প্রতিমা গড়ার কাজ শেষ হলে রঙের কাজ শুরু হবে বলেও জানান এই প্রতিমা শিল্পী।
এদিকে, রাজশাহী হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি অনিল কুমার সরকার জানান, রাজশাহীতে এবার ৪৫২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। পূজার নিরাপত্তা নিয়ে আগামী সপ্তাহে রাজশাহী পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকবেন। সুষ্ঠু ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে এ বছর দুর্গাপূজা আয়োজনের জন্য এরইমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান হিন্দু ধর্মীয় এই নেতা।
তিনি জানান, আগামী ১৪ অক্টোবর (রোববার) দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে ছয় দিনব্যাপী এই শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হবে। ১৫ অক্টোবর আমন্ত্রণ ও অধীবাস, ১৬ অক্টোবর দেবীর সপ্তমীবিহিত, ১৭ অক্টোবর দেবীর মহাঅষ্টমীবিহিত, কুমারী পূজা, সন্ধি পূজা, ১৮ ই অক্টোবর দেবীর নবমীবিহিত এবং ১৯ অক্টোবর মহাদশমীতে বিহিত পূজা, সমাপন ও দর্পন বিসর্জন এবং সন্ধ্যা আরত্রিকের পর প্রতিমা বির্সজনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ দুর্গোৎসব।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮
এসএস/জেডএস