নারায়ণগঞ্জ থেকে: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন শ্রমিক।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে টানা ১৯ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তবে এখনও ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় আগুন জ্বলছে।
৩৪ হাজার বর্গ ফুট জায়গার উপর স্থাপিত সেজান জুস কারখানায় কয়েকটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের তেমন কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। এছাড়াও ভবনের উপরে ওঠার দুটি সিঁড়ি ত্রুটিপূর্ণ। ভবন ও কারখানার লিফ্ট ঘিরে ওঠা সিঁড়িগুলো একেবারেই উপযোগী নয় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
কারখানাটিতে বোতল তৈরি থেকে শুরু করে জুস বোতলজাত করার সব কাজ হতো। কারখানায় প্ল্যাস্টিক দানা, বোতল, কর্ক, পলিথিন, কার্টন, মোবিল ও জুসে মেশানো বিভিন্ন কেমিক্যাল মজুদ রাখা ছিল। এসব কেমিক্যাল থাকার কারণে কারখানার আগুন নির্বাপণে বেগ পেতে হয় হয় বলে জানার ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
শুক্রবার (০৯ জুলাই) ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরে সরেজমিনে দেখা যায়, নিচতলায় গোডাউন। বিভিন্ন কার্টন, প্ল্যাস্টিকের কাঁচামাল, কর্ক ও বোতল মজুদ রয়েছে। আগুনের তাপে ভবনের সিঁড়ির পাশের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। ভবনের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ডাম্পিংয়ের কাজ করছেন।
ঘটনাস্থলে কর্মরত ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, কারখানা ভবনটি ৬ তলা। পুরো ভবনে ওঠা-নামার জন্য মাত্র দুটি সরু আকৃতির সিঁড়ি রয়েছে। তবে ভবনে অগ্নিনির্বাপণের জন্য নেই কোনো ফায়ার হাইড্রেন, নেই বহির্গমনের সিঁড়ি। ভেতরে কিছু এক্সটিংগুইশার ছাড়া তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।
ভবনের নিচতলা, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় নেট দিয়ে বেরা দিয়ে ছোট ছোট কম্পাউন্ড করা রয়েছে। ভবনের দুটি সিঁড়ি দুটি লিফ্টকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে, যা ত্রুটিপূর্ণ। এরপর ছাদে ওঠার রাস্তা কলাপসিপল গেট ও নেটের গেট দিয়ে আটকানো।
শ্রমিক, প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, সেজান জুস কারখানায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কারখানাটি তিন শিফটে পরিচালিত হয়। তবে শ্রমিকদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। কারখানাটিতে জুস, লাচ্ছি সেমাইসহ বিভিন্ন পণ্য বোতলজাত ও প্যাকেজিং করা হতো। এসব পণ্যের মোড়ক লাগানো হতো। ভবনের নিচ তলায় গোডাউন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কারখানা, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় ছিল বিভিন্ন কেমিক্যালের গোডাউন।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দিনমণি শর্সা বাংলানিউজকে বলেন, ভবনের তেমন কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আমাদের চোখে পড়েনি। আগুন লাগার পর কারখানার শ্রমিকরা যে নামবে সে জন্য ভবনের সিঁড়ি দুটি ছিলো সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। ভবনে কোনো ফায়ার হাইড্রেন ছিল না। কারখানার কোনো নিয়ম এখানে মানা হয়নি।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মুস্তাফিজুর বাংলানিউজকে জানায়, ভেতরে এখনও আগুন জ্বলছে। ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় গেট লাগানো। সেখানে প্রচণ্ড তাপের কারণে ভেতরে যাওয়া যাচ্ছে না। তৃতীয় ও চতুর্থ তলা থেকে শ্রমিকদের সব মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা পানি নিয়ে ভবনের তাপ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। তবে আগুন এখনও সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা সম্ভব হয়নি।
কারখানার শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ছয় তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরের কার্টন থেকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। আবার কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে ভবনের ডাম্পিংয়ের কাজ চলছে। আগুনের কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণের পর আমরা তদন্ত শুরু করবো। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত ওই কারখানায় আগুনের সূত্রপাত হয়। এ অগ্নিকাণ্ডের সবশেষ মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জনে। এছাড়াও আরও অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট নিউজ:
>>>পুত্রবধূর মরদেহ শনাক্ত করতে আহাজারি শাশুড়ি রাহিমার
>>>রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড: মরদেহ-স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু
>>>আগুনের ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে কঠোর ব্যবস্থা: র্যাব ডিজি
>>>‘একটু লাশ খুঁজে দেন’—মর্গে নিখোঁজদের ছবি নিয়ে স্বজনরা
>>>‘ভবনের ছাদে উঠার পথ বন্ধ থাকায় মৃত্যু বেড়েছে’
>>>রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড: কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি
>>>অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের সহায়তার ঘোষণা শ্রম প্রতিমন্ত্রীর
>>>রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড: অর্ধশতাধিক মৃত্যুর ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন
>>>নেভেনি আগুন, তৈরি হচ্ছে নিখোঁজদের তালিকা
>>>আগুনে পুড়ে অবশিষ্ট ছিল মরদেহগুলোর হাড়
>>>রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড: ৪৯ মরদেহ ঢামেক মর্গে
>>>সেজানের পোড়া কারখানা থেকে বের হলো ৫২ মরদেহ
>>>নিয়ন্ত্রণে আসেনি সেজান জুসের কারখানার আগুন, নিহত ৩
>>সেজান জুসের কারখানায় আগুন: কয়েকজন ঢামেকে ভর্তি
>>>রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানায় আগুন, নিহত ২
>>>১৫ ঘণ্টাও নেভেনি আগুন, ফায়ার সার্ভিসের ক্লান্তিহীন চেষ্টা
>>>জুস কারখানায় অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ থাকায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না আগুন
>>>জীবিত নেই কেউ, প্রিয়জনের খবর পেতে স্বজনদের অপেক্ষা
বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০২১
এসজেএ/এমজেএফ