ঢাকা: দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার পর এবার তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যাচেষ্টা শুরু হয়েছে। কিলিং মিশন সফল করতে বিভিন্ন কৌশলে ভাড়াটে খুনিরা ব্যবসায়ীদের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, বেসরকারি খাতকে ধ্বংস করতে রাষ্ট্রবিরোধী একটি চক্র তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে। তারই অংশ হিসেবে হয়রানিমূলক মামলার পাশাপাশি হত্যাচেষ্টা শুরু হয়েছে। সবশেষ দেশের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তা পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে একাধিকবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের অর্থনীতির বিকাশ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে অসামান্য অবদান রাখছে। বসুন্ধরা গ্রুপ এক এক করে ৪০টির বেশি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
এর আগে কয়েক মাস আগে ঢাকার বোট ক্লাবের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদকে নানাভাবে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়। যদিও পরবর্তীতে জামিন পেলেও নায়িকা পরীমনির দায়ের করা হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা থেকে এখনো অব্যাহতি পাননি তিনি। সেই সময় নাসির ইউ মাহমুদকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এমনকি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর পেছনেও কোনো এক কুচক্রী মহল রয়েছে। যাদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করে চক্রটি পরিকল্পিতভাবে ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে ফায়দা লোটার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এমনকি ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়েও ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছিল। সে সময় তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক বিপুল পরিমাণ টাকাও আদায় করা হয়। অন্যায়ভাবে জেলে নেওয়া হয়েছিল অসংখ্য শীর্ষ ব্যবসায়ীকে। ফলে সে সময় স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। তবে এখন তারা আর শুধু হয়রানিতেই থেমে নেই। একটি কুচক্রী মহল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে রাষ্ট্রেরই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার আড়ালে ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করে ব্যবসায়ীদের হত্যার পাঁয়তারা করে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য আবারো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতে এমনিতেই সারাবিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনা অচলবস্থার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। আর সেই মুহূর্তে শুরু হয়েছে দেশবিরোধী কুচক্রী মহলের গভীর ষড়যন্ত্র। তারা ব্যবসায়ীদের হত্যার নীলনকশা এঁকেছে। মূলত দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করতে চায় এই কুচক্রী মহল।
কুচক্রীদের পরিকল্পনা ছিল গত শুক্রবার (৫ নভেম্বর) জুমার নামাজের সময় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরকে গুলি করে হত্যা করা। ওইদিনই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাউতুল কোরআন মাদরাসা ও এতিমখানা থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে সাইফুল ইসলাম সাদ (২৩) নামে চট্টগ্রামের পটিয়ার এক যুবককে আটক করে রাজধানীর ভাটারা থানা পুলিশ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাদ জানায়, শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজ চলাকালে সায়েম সোবহান আনভীরকে গুলি করে হত্যার প্রস্তুতি ছিল তার। পটিয়ার সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবং তার ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরীর নির্দেশে হত্যার এ পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে সাদ। তার আগে দুধের মধ্যে বিষ মিশিয়ে এবং ছুরিকাঘাতে হত্যার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েছে চক্রটি।
এ ঘটনার পর সারাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় শিল্পপতিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একের পর এক মামলার পরে হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা রুখতে না পারলে দেশের অর্থনীতি আবার গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাধাগ্রস্ত হবে রপ্তানি ও শিল্পায়ন। ছন্দপতন ঘটবে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভে। ব্যাহত হবে সরকারের প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন।
কৃষির পর ব্যবসা-বাণিজ্যই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ ব্যবসায়ীদেরই নানাভাবে হয়রানি ও হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আবার এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনকারীরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি রাষ্ট্রের নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা, দেশের উন্নয়নে যারা ভূমিকা রাখছেন তাদেরই নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এতে শুধু ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি হচ্ছে না। বরং দেশ ও দেশের অর্থনীতি আজ হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কেননা শীর্ষ ব্যবসায়ীরাই বেসরকারি খাতের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। এমনকি যে কোনো ধরনের মহামারি, খরা, বন্যা বা সংকট উত্তরণে সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে এই বেসরকারি খাত। এই বেসরকারি খাতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বেসরকারি খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে ব্যবসায়ীদের খুনের পরিকল্পনা করা হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
উদ্যোক্তাদের জানমালের নিরাপত্তা
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সভাপতি হুমায়ুন রশীদ বলেছেন, আমরা চাই ব্যবসায়ীরা যেন সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যবসা করেন। তা হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হতে পারে। নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বসুন্ধরা দেশে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। সুতরাং, সরকারের কর্তব্য তাদের নিরাপত্তা দেওয়া যাতে তারা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের বিনিয়োগে আতঙ্কিত না হয়। যে কোনো বিনিয়োগকারীর কোনো সমস্যা হলে তা যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা উচিত বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হত্যাচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে হুমায়ুন রশীদ বলেন, এক-এগারোর পর জরুরি অবস্থায় কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল না। কিন্তু এখন আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে। তাই আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হোক।
কুচক্রী মহলকে আইনের আওতায় আনতে হবে
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) প্রথম সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, এই কুচক্রী মহল যেই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, উদ্বেগজনক ঘটনা। বসুন্ধরা গ্রুপের মতো একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপের এমডিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা মানেই দেশের অর্থনীতির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করা। যারা দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান করছেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের বিরুদ্ধে এমন হত্যার পরিকল্পনা খুবই দুঃসাহসিক কাজ। এটা যারা করেছে, তারা নিশ্চই কোনো না কোনো পক্ষের স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এর মাধ্যমে হুমকির মুখে পড়বে দেশের আর্থিক খাত। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে হত্যার ষড়যন্ত্রের ঘটনায় আমরা ব্যবসায়ী সমাজ বিস্মিত। আমরা ক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে এর পেছনে যারা রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।
স্বার্থান্বেষী মহল অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়
বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দিন বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আইন দিয়ে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। দেশের বড় বড় গ্রুপগুলো নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে চেষ্টা করছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির। কিন্ত ক্রমেই তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা কমে যাচ্ছে। সব পক্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। পদে পদে ব্যবসায়ীদের হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। সম্মান নিয়ে চলার জন্য সব জায়গায় আপস করে চলতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীর মর্যাদা বিবেচনা না করে কখন কে কোন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে দেবে, এ নিয়েই উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সামজিকভাবে হেয় করা, গ্রেফতার করা, জেল দেওয়ার ঘটনা অহরহ হচ্ছে।
এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়ববদ্ধতা থেকে ব্যবসায়ীরা সবসময় দেশে বিনিয়োগ করতে চান। অনেক ব্যবসায়ী অপমানের ভয়ে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। দেশে বিনিয়োগও করছেন না, দেশে থাকতে চাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতির যদি অবসান না হয়, তাহলে আমাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
মোস্তফা কামাল মহীউদ্দিন বলেন, বিদেশে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়, যেহেতু তারা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। সামাজিকভাবে ব্যবসায়ীদের সম্মানিত করা হয়। কিন্ত দেশে বিশেষভাবে যারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত তারা ছাড়া প্রকৃত ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি নেই।
বিএলডিএর মহাসচিব আরও বলেন, কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে তাদের আইনের আওতায় বিচার হবে। কিন্ত স্পষ্টত ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কাউকে ফাঁসালে সেখানে কেন প্রটেকশন পাওয়া যাবে না? সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, যারা সমাজে অবদান রেখে চলেছেন, তাদের যদি হয়রানি করা হয় তাহলে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও নেতিবাচক বার্তা পান। এই পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট ও সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি গভীরভাবে না দেখা হয় তাহলে দেশের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবকিছুতেই পরিণতি শুভ হবে না।
আরও পড়ুন:
বসুন্ধরার এমডিকে একাধিকবার হত্যাচেষ্টা, পটিয়ার যুবক আটক
বসুন্ধরার এমডিকে হত্যাচেষ্টা: প্রতিবাদে মানববন্ধন
বসুন্ধরার এমডিকে হত্যাচেষ্টা, খুলনার ব্যবসায়ী নেতাদের নিন্দা
বসুন্ধরার এমডিকে হত্যাচেষ্টা: দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়
বসুন্ধরা এমডিকে হত্যাচেষ্টা: সাদের রিমান্ডের আদেশ বিকেলে
বসুন্ধরা এমডিকে হত্যাচেষ্টা: তিনদিনের রিমান্ডে সাদ
বসুন্ধরার এমডিকে হত্যাচেষ্টা, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতাদের নিন্দা
বসুন্ধরার এমডিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবি
শীর্ষ ব্যবসায়ীদের হত্যার পাঁয়তারা অর্থনীতি ধ্বংসের নীলনকশা
বাংলাদেশ সময়: ২৩০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০২১
এসই/এমজেএফ