ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজে এখনও অচ্ছুত!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২২
দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজে এখনও অচ্ছুত!

নাচোল থেকে ফিরে: ১২ বছরের শিশুটির নাম প্রেম। তার বাবা গুলজার মারা গেছেন অনেক আগে।

এক ভাই এক বোন তারা। প্রেম স্থানীয় একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তার বড় বোন প্রশিকা (১৪) নচোল মুন্সি হযরত উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। কিন্তু পড়াশোনা করলেও তারা কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। কারণ তাদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। কেউ কথা বলতে চায় না, বসতে চায় না পাশে। এখনও হোটেল-রেস্তোরাঁয় গেলে তাদের বসে খেতে দেওয়া তো দূরের কথা ঢুকতেও দেয় না। স্কুলে যাওয়ার সময় কখনও তৃষ্ণা পেলে পানি চাইলে কাচের গ্লাস রেখে স্টিলের মগে পানি দেওয়া হয়। আর চা চাইলে পাত্র নিয়ে যেতে হয়। অনেক ওপর থেকে সেই পাত্রে গরম চা ঢেলে দেওয়া হয়। তাই অনেক সময় পরিবারের জন্য চা আনতে গেলে ঢালতে গিয়ে গায়েও ছিটকে পড়ে সেই ফুটন্ত চা!

এই ছিল দলিত সম্প্রদায়ের পরিবারের একটি শিশুর করুণ জীবন গাঁথা।

মাত্রই প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়েছে কোমলমতি এই শিশু। এরই মধ্যে সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের আচরণে বুঝতে পারে সে সমাজের মূলধারা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন! মোটামুটি অবস্থাপন্ন মুসলমান বা উচ্চবর্ণের হিন্দু বা খ্রিস্টান ঘরের কোনো শিশুই মিশতে চায় না তার সঙ্গে। দলিত-হরিজনরা যেন অস্পৃশ্য। এখনও পানি ও চা পান করতে দোকানে গেলে নিজের গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। সমাজের ৮/১০ জন মানুষের মতো তারাও রক্তে-মাংসে গড়া এবং শিক্ষিত। অথচ তারা আজও অচ্ছুত!

এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি, না হলে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অবদানকে অস্বীকার করা হবে, তাদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে- যারা এমন বড় বড় বুলি আওড়ান তারাও পেছনে ঘৃণার চোখেই দেখেন তাদের। সামনে অধিকার আদায়ের কথা বলে পেছনে গিয়ে তাদেরকে সমাজ থেকে আলাদা করেন, আলাদা রাখেন। নির্বাচন এলে জনপ্রতিনিধিরা ভোট নিতে তাদেরকে মা ও মাসি বলে ডাকেন। কিন্তু ভোট গেলে তাদের কথা এবং তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান।

এখনও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ ও বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কী গ্রাম আর কী শহর; সবখানেই তারা নিগৃহীত। সবখানেই সামাজিক ও সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রিয় অধিকার থেকে বঞ্চিত। কেবল শিশু প্রেমের গ্রামের বাসিন্দারাই নন, সারা দেশের দলিতদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন এখন অনেকটা এমনই। নিজেদের আদি পেশা, কৃষ্টি, জাত ও বর্ণ বৈষম্যের কারণে দিন দিন আরও পশ্চাৎপদে যাচ্ছে এই বিশাল দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ।

বিশ্বে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ কোটি। এরমধ্যে ২১ কোটি বসবাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর এই দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত নিষ্পেষিত হয় পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা ঠিক কত তা নিয়েও আছে ধোঁয়াশা। তবে সারা দেশে প্রায় ৬৫ লাখ জনগোষ্ঠী আপাতত ‘দলিত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।  

আর সংখ্যা যাই হোক, দলিত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের কথা উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১০ সালে দলিতদের জীবনমান উন্নয়নে আলাদা অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজের অউন্নত সব জাতিসত্তাকে এগিয়ে নিতে সরকার নানান পরিকল্পনা নিলেও সেই অচ্ছুতই হয়ে আছেন দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ।

বলা যায়- প্রায় সভ্যতার শুরু থেকেই সামাজিক বঞ্চনা, অস্পৃশ্যতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে এখনও বৃত্তের বাইরেই থেকে গেছেন তারা।  

পিছিয়ে থাকতে থাকতে এখন যেন শুদ্ধ চিন্তা করতেই ভুলে গেছেন ‘নিচু বর্ণের হিন্দু’ তথা ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো। একবিংশ শতাব্দির এই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এসেও অস্পৃশ্যতা, বৈষম্য, চাকরিতে সুযোগ কম পাওয়া, শিক্ষা ও দরিদ্রতার ঘেরাটোপে অবর্ণনীয় এক অমানবিকতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা। দিন দিন যেন আরও পেছনেই হাঁটছেন দলিত জনগোষ্ঠী।

এক কথায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান কোনো দিক থেকেই স্বস্তিতে নেই দলিত সম্প্রদায়। ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়েই অধিকাংশ শিশু ঝরে যায়। আবার কোনোভাবে সাবার সাথে যুদ্ধ করে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুলেও বৈষম্যের কষাঘাতে মাধ্যমিকে গিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে তাদের উজ্জ্বল শিক্ষা জীবন। বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলের দলিতরা এখন চরম অস্পৃশ্যতার শিকার।  সর্বোত্তরে থাকা রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এমনই একটি জেলা। উত্তরের এই জেলার নাচোল উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও সদর পৌরসভায় রয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।

নচোল পৌর বাজার ঘেঁষা একটি ছোট একটি সরকারি থাস জায়গায় সন্তান নিয়ে যুগের পর যুগ থেকে বাস করে আসছেন ছয়টি দলিত পরিবাবের প্রায় অর্ধশতাধিক মনুষ। সেখানকার একজন স্থায়ী বাসিন্দার নাম বাসন্তি (৫৫)।

পূর্বনুসারীদের মতো তিনিও সদর পৌরসভায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। সমাজের মূলধারা থেকে তারা যে কতটা বিচ্ছিন্ন এই বিষয়টি যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে জানান।  

প্রতিবেশীদের আচরণ এমন যে, তারা যেন কোনো ভিনগ্রহের বাসিন্দা। এত বছরেও এই সমাজের কেউ তাদেরকে বা তাদের সন্তানদের মেনে নেয়নি। কিন্তু মাথা গোঁজার সামান্যটুকু জায়গাও নেই। তাই এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতেও পারেন না।

সুইপার কলোনিখ্যাত এই এলাকার হরিজন নারী মেনুকা (৪৫)। তিনি ছোটবেলা থেকে এখানে বসবাস করেন। পৌরসভায় ঝাড়ু দেন। কিন্তু আজও তার চাকরি স্থায়ী হয়নি। তিনিসহ মোট ছয়জন নারী এই পৌরসভায় কাজ করেন। তারা মাসে এক হাজার ৫শ টাকা করে বেতন পান। এখন এই টাকায় কী হয় প্রশ্ন করেন।

তিনি বলেন, এই কারণে তিনি তার সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেন না।  

কথা হয় নাচোল উপজেলা হরিজন ও ডোম যুব উন্নয়ন কমিটির সভাপতি সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে।

সঞ্জয় বলেন, তারা নিচু জাত। সমাজের লোক তাদের সঙ্গে মেশেন না। এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে মোট ৩০টি ঘর রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ রয়েছেন তাদের দলিত সম্প্রদায়ে। কিন্তু তারা সমাজে এক ঘরে হয়ে বসবাস করেন। এখানকার অনেকেই তাদের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে চান কিন্তু অনেক স্কুলই ভর্তি নেয় না। কোনো স্কুলে কষ্টেসৃষ্টে ভর্তি করা গেলেও স্কুলে পাঠানোর পর কেউ তাদেরকে মেনে নেয় না। ক্লাসে ঢুকতে দেয় না। পাশে বসতে দেয় না! সবখানেই তারা বৈষম্য ও চরম কটাক্ষের শিকার হন। এজন্য তাদের ছেলে-মেয়েরা আর স্কুলে যেতে চায় না। তাই দলিত সম্প্রদায়ের শিশুরা প্রাথমিকে লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও মাধ্যমিকের আগেই ঝরে পড়ছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ শ্রেণীকক্ষ সব জায়গাতে এখনও তারা অচ্ছুত! তাই তাদেরকে এগিয়ে

নিতে মানসিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর পাশাপাশি সাংবিধানিকভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সব নাগরিকের মতো দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমকেও ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন তারা।  

মানবাধিকার কর্মী সুব্রত কুমার পাল বলেন, সংবিধানের ১৪, ২৭, ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েঝছে- ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বৈষম্যের শিকার ব্যক্তির পক্ষে আদালতের আশ্রয় নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে এসব মানুষ বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার শিকার হলেও তারা বিচারের আশ্রয় নিতে পারছেন না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং আইন কমিশন দলিত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ‘বৈষম্য বিলোপ’ আইনের খসড়া করেছে। কিন্তু খসড়া তৈরি হলেও ‘বৈষম্য বিলোপ’ আইনটি এখনও পাস হয়নি সংসদে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ দলিত সম্প্রদায়কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু অনুসরণীয় পদক্ষেপ নিলেও এই আইন পাস করতে পারেনি সরকার।

সাংবিধানিকভাবে সব নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এই আইনটি। তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৬৫ লাখ দলিত জনসংখ্যা আমলে নিয়ে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
 
গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, মানুষে মানুষে যে সৌহার্দ্য, মানুষে মানুষে যে ভালোবাসা তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ যে আমাদের মতোই সাধারণ নাগরিক তা মেনে নিতে হবে। তবে এই বিষয়গুলো আমাদের মনোজগতে আসে না। চিন্তার রেখাপাত করে না। এর কারণ, আমাদের যারা নীতিনির্ধারণীতে রয়েছেন তারাও সেটা মানুষের মধ্যে আনতে চান না। এজন্য আমাদের মনোজগতের একটা বিশাল পরিবর্তন দরকার। এজন্যই আমরা গণমাধ্যমকর্মীদের আরও সক্রিয় করতে চাই, সচেতন করতে চাই। গণমাধ্যমের মাধ্যমেই মানুষ আরও সচেতন হবে, তাদের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হবে এবং সংবেদনশীল হবে। তখনই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

দেশে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন- ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান গবেষক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ বোরহান কবীর।

তিনিও প্রায় একই কথা বলেন।  

তিনি বলেন, দেখুন এসব ঘটনা একটা জিনিস প্রমাণ করেছে যে- শুধু আইন যদি করি আমি বা রাষ্ট্র যদি একটা সিদ্ধান্ত নেই তাহলেই সবকিছু সম্ভব না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চিন্তা চেতনা এবং আমাদের মনোজগতে আমরা পরিবর্তন না আনবো ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়। সরকার যেটা করেছে- সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে এবং এটা অবৈতনিক করেছে। কিন্তু আপনি দেখলেন যে, এখানে আমরা যাদের কথা বললাম বা বলছি- তারা কিন্তু স্কুলে যেয়ে তার সহ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতা পাচ্ছে। তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের মনোজগতের একটা পরিবর্তন দরকার। আমরা তার জন্যই গণমাধ্যমকে আরও সক্রিয় করতে চাই। আরও সচেতন করতে চাই। যখন গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ সচেতন হবে তখন তারা দলিতদের প্রতিও দায়িত্বশীল হবে। আর মূলত তখনই এই অবস্থাগুলোর পরিবর্তন হবে, তার আগে নয়’।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২২
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।