খুলনা থেকে: কুইজের মতো মনে হতে পারে, তবু লিখতে হচ্ছে। প্রেসবক্স থেকে কোন টেস্ট ভেন্যুর চারিদিকে সবুজের হাতছানি?
ক্রিকেটবিশ্বের প্রায় সব ভেন্যু থেকে ম্যাচ কভার করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারাও হয়তো খানিকটা দ্বিধায় পড়ে যাবেন এই প্রশ্নে।
সঠিক উত্তরটা একেবারে চটজলদি বলে ফেলা যাবে তা-ও কিন্তু নয়। তবে সেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে খুলনার নামটা আপনার মনের কোনে উঁকি দেবেই। হয়তো আসবে ডানেডিনের নামটাও।
তারপরও স্টেডিয়াম বললে খুলনাই বোধহয় এগিয়ে থাকবে। তবে সেই খুলনা স্টেডিয়ামের বাইশ গজে সবুজ বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তার অর্থ এই নয় যে, টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া কোনো পেসারকে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার বল করিয়েই সরিয়ে নিতে হবে! যদিও এক ওভারের সেই স্পেলে মোহাম্মদ শহীদ ৬ রান দিয়েছিলেন। এরপর অভিষিক্ত হওয়া বোলারের আত্মবিশ্বাসটা কোথায় নেমে যেতে পারে সেটা উপলব্ধি করা খুব কঠিন কাজ মনে হয় না। দিন শেষে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসটাও নিম্নমুখি।
সেটা ফিরে পেতে কোনো একজন বোলারের কাছ থেকে একটা স্বপ্নের স্পেল চাইছে বাংলাদেশ। আর সেটা খুঁজতে গিয়ে আটজন বোলার ব্যবহার করলেন মুশফিক এবং তামিম!
তামিমের নামটা পড়ে চমকে উঠতে পারেন অনেকে। তাদের জন্য জানিয়ে রাখতে হচ্ছে চা-বিরতির ঘণ্টাখানেক পর শহীদের বলে আজহার আলীর ক্যাচ নিতে গিয়ে ডান হাতের অনামিকায় চোট পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন মুশফিক।
তার জায়গায় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন তামিম। দিনের শেষ দিকে তিনি বল তুলে দিয়েছেন মাহমুদ উল্ল্যাহ, সৌম্য সরকার মুমিনুলের হাতেও! শেষ ওভারে যদিও রুবেল হোসেনকে ফেরালেন।
কিন্তু দলের আত্মবিশ্বাস আর ফেরাতে পারলেন না। কারণ রুবেল কোনো উইকেট পেলেন না। ১১ ওভারে ৫০ রান দিয়ে উইকেট-শূন্য রুবেল। আর ইনিংসের ৩৫তম ওভারে মুশফিক যখন মোহাম্মদ শহীদকে ফিরিয়ে আনলেন তাঁর দ্বিতীয় স্পেল করার জন্য, তখন উইকেটে দারুণভাবে সেট হয়ে গেছেন মোহাম্ম হাফিজ আর আজহার আলী। তারপরও আজহার আলীকে প্যাভিলিয়নে ফেরানোর কাজটা তিনি প্রায় করেই ফেলেছিলেন।
কিন্তু ২৮ রানে থাকা আজহারের ক্যাচটা মুশফিক ড্রপ করলেন! আজহার ফিরতে পারতেন ১১ রানেও। শেষ পর্যন্ত আজহার নয়, আঙুলে চোট পেয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেন মুশফিকই।
এক্স-রে রিপোর্টে অবশ্য তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। তাই হয়তো আশা করা যায় তৃতীয় দিন গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে ইমরুল কায়েস নন, মুশফিক-ই দাঁড়াবেন।
কিন্তু পাকিস্তানের ইনিংস খুব তাড়াতাড়ি গুটিয়ে দিতে পারবে বাংলাদেশ--এমন আশা করা কঠিন। টেস্ট ক্রিকেটে রং পাল্টাতে সময় লাগে না, কথাটা মাথায় রেখেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের বোলাররা অতি নাটকীয় কিছু ঘটিয়ে ফেলবেন! দ্বিতীয় দিন শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ ১ উইকেটে ২২৭ রান।
বাংলাদেশের চেয়ে ১০৫ রানে পিছিয়ে। তবে উইকেটে আছেন মোহাম্মদ হাফিজ ( ১৩৭*) আর আজহার আলী ( ৬৫*)। আর প্রায় দুই সেশন প্যাড পরে ড্রেসিংরুমে বসে থেকে থেকে ক্লান্ত ইউনিস খান। শেষ পর্যন্ত তিনি ড্রেসিংরুম থেকে বার কয়েক সিঁড়ি ভেঙে উপর-নিচে দৌড়ে ক্লান্তি দূর করলেন! মোহাম্মদ হাফিজ অপরাজিত ১৩৭ রানের ইনিংস খেলার পথে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি করে নাম লেখালেন জহির আব্বাস, মুদাস্সর নজর, শোয়েব মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ইউসুফ এবং ইউনিস খানের সঙ্গে। টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই। মোহাম্মদ ইউসুফ অবশ্য কাজটা করেছেন দুই দুই বার। হাফিজ যদি এখন ক্যারিয়ারের প্রথম ডবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখেন, তাহলে তা বাড়াবাড়ি হবে না। আজহার আলী মুশফিকের সৌজন্যে বার দুয়েক লাইফ পেয়ে সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
প্রথম ইনিংসে তিনশ রানই লিড নেয়ার জন্য যথেষ্ট-- এই ‘তত্ত্ব’ যিনি দিয়েছিলেন সেই মুমিনুল পাকিস্তানের ইনিংসে লম্বা একটা সময় কাটিয়েছেন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করে। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের নিশ্বাসের শব্দও প্রায় শোনা যায় যেখান থেকে, সেই মুমিনুল হাফিজের ব্যাটিং দেখে এখন ভাবতেই পারেন, উইকেট ব্যাট করার জন্য এতো সহজ হয়ে গেল কিভাবে! তিনি ভুল না সঠিক সেটা এখনো হয়তো বলা যাচ্ছে না। তবে একটা কথা বলা যেতেই পারে, আগের দিন ৮০ রানের ইনিংস খেলে উঠে এসে তিনি যা বলেছিলেন সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট মহলে অনেক দিন ঘুরপাক খাবে। ‘৮০ রান করতে মনে হয়েছে একশ বছর লাগবে!’ সেই কথার ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে মোহাম্মদ হাফিজ দিব্যি হেসেখেলে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে ফেললেন। সময় নিলেন মোটে ২৪৬ মিনিট। আর সেঞ্চুরি করলেন ১৭৫ মিনিটে মাত্র ১২৩ বল খেলে। রুবেলের বলে স্কোয়ার ড্রাইভ করে বাউন্ডারি মেরেই তিন অংকের কোটায় পৌঁছে যান তিনি। রুবলের ঐ ওভারেই তিনি তিনটা বাউন্ডারি সহ তুলে নেন ১৩ রান। পাকিস্তান ইনিংসে এক ওভারে ওটাই সবচেয়ে বেশি রান। তবে এর সাথে আরও একটা তথ্য দিতে হচ্ছে, মোহাম্মদ হাফিজ ৮০ রান করেছিলেন ঠিক একশ বল খেলে ১৪২ মিনিটে!
তিনশ রান নয়, বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে করেছে ৩৩২ রান। তারপরও বাংলাদেশ লিড পাবে সেটা ভাবা যাচ্ছে না। কারণ, পাকিস্তানের হাতে এখনো ৯ উইকেট। আর ব্যাটিং লাইনে সব সমীহ জাগানো নাম: মোহাম্মদ হাফিজ, আজহার আলী, ইউনিস খান, মিসবাহ উল হক, আসাদ শফিক, সরফরাজ আহমেদ।
বাংলাদেশের মতো খুব অল্প রানে যদি শেষ পাঁচ ছয় উইকেট না হারায়, তাহলে প্রথম ইনিংসে লিড শুধু নয়, খুব বড় লিড নেয়ার কথাও ভাবতে পারে পাকিস্তান। বাকি ব্যাটসম্যনদের পারফর্ম করার জন্য ভাল একটা পাটাতন তৈরি করে ফেলেছেন হাফিজ আর আজহার।
ও হ্যাঁ, ‘বাংলাদেশের মতো অল্প রানে শেষ পাঁচ-ছয় উইকেট হারানো’-ার কথাটা যখন লেখা হলো তখন আরো একটা বাক্য লিখতে হচ্ছে: বাংলাদেশ শেষ পাঁচ উইকেট হারিয়েছে ২৭ রানে! এবং সেই বাংলাদেশ যারা মুলত: আটজন ব্যাটসম্যান নিয়ে টেস্ট খেলছে!
পাল্টা যুক্তি আসতে পারে শুভাগত হোম তো অলরাউন্ডার হিসেবে খেলছেন। তাহলে বলতে হবে সাত নম্বরে খেলছেন নিখাদ ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার! ভুল হচ্ছে, সৌম্য একেবারে ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন না, সেটা প্রমাণ করলেন মুশফিকের জায়গায় অধিনায়কের দায়িত্ব নেয়া তামিম।
সৌম্যকে দিয়েও এক ওভার বল করানো হয়েছে। অথচ একাদশের বাইরে লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন। যিনি চট্টগ্রামে তাঁর শেষ টেস্টে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট।
এরই মধ্যে সেটা হয়তো হয়ে গেছে অতীত!কিন্তু আগামীর কথা ভাবতে গিয়ে বাংলাদেশকে ভাবতে হচ্ছে কতো দ্রুত পাকিস্তানের শেষ ৯টা উইকেট তুলে নেয়া যায়!
তবে কুইজের কিউ দেয়ার মতো একটা কথা লিখতে হচ্ছে শেষে, আর ১০৬ রান করলেই কিন্তু লিড নেবে পাকিস্তান।
খুলনার উইকেটের আচরণ দেখে এখন মনেই হচ্ছে না, এই উইকেটে লিড নেয়ার জন্য তিনশ রান যথেষ্ট!
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৯ ঘণ্টা, এপিল ২৯, ২০১৫
জেএম