বরগুনা: উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে ওঠা ছোট বড় মাজারি কয়েক শতাধিক বড়ই বাগানের কারেন্ট জালে প্রতিদিন মরছে শত শত উপকারী পাখি। এভাবে প্রতিদিন শত শত পাখি মৃত্যুর ফলে মৌসুম ভিত্তিক ধানসহ বিভিন্ন ফসল ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অশঙ্কা করছেন বিশেষঞ্জরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় প্রায় শতাধিক বড়ই বাগান রয়েছে। কৃষকরা অধিক লাভের আশায় এসকল বাগান করে থাকে। এর মধ্যে আমতলী উপজেলায় ৬০টি এবং তালতলী উপজেলায় ৪০টি বাগান রয়েছে। এসকল বড়ই বাগানে শীত মৌসুমে ফল আসে। ফল আসার সময় থেকে পাঁকা পর্যন্ত পাখিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এক ধরনের জাল দিয়ে পুরো বাগান মুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফল রক্ষার জন্য মুড়িয়ে দেওয়া বাগানের জালে আটকা পরে প্রতিদিন মরছে শত শত পরিবেশের ভারসম্য রক্ষাকারী দোয়েল, বুলবুলি, সুঁইচোরা, ছোট বাদুর, বড় বাদুরসহ নানা উপকারী পাখি। এসকল পাখি ধানসহ বিভিন্ন ফসল রক্ষার জন্য ক্ষতিকর পোকা ক্ষেয়ে কৃষকের উপকার করে থাকে। এতে সারসহ কীটনাসক কম ব্যবহার করতে হয়।
বরগুনা সদর উপজেলার বদরখালী, ঢলুয়া, ফুলঝুড়ি, ৬ নম্বর বুড়িরচর, বালিয়াতলী ও আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর রাওঘা, দক্ষিণ রাওঘা, কুকুয়া ইউনিয়নের চরখালী, পশ্চিম চুনাখালী, রায়বালা,পূর্ব চুনাখালী, গুলিশাখালী ইউনিয়নের বাইনবুনিয়া, খেকুয়ানি, আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের সোনাখালী, চাওড়া ইউনিয়নের কালিবাড়ি, তালতলী উপজেলার দক্ষিণ বাদুরগাছা, পশ্চিম বাদুরগাছা, পূর্ব বাদুরগাছাসহ বামনা উপজেলা, পাথরঘাটা উপজেলা, বেতাগী উপজেলা ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কয়েক শতাধিক বড়ই বাগানে কৃষকরা বড়ই (কুল) চাষ করেছে।
আমতলী ও তালতলী উপজেলার আমতলী কুকুয়া ইউনিয়নের রায়বালা গ্রামের হামিদা, আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের সোনাখালী গ্রামের হারুন তালুকদার, তালতলী উপজেলার দক্ষিণ বাদুরগাছা গ্রামের ছিদ্দিক খান, পশ্চিম বাদুরগাছা গ্রামের আব্দুল আজিজ হাওলাদার ও পূর্ব বাদুরগাছা গ্রামের আলতাফ তালুকদারের বাগান ঘুরে দেখা যায়, বড়ই রক্ষার জন্য মুড়িয়ে দেওয়া জালে পা এবং পাখনায় আটকা পড়ে শত শত পাখি মরে আছে। আটকা পড়া আবার কিছু পাখি জীবিত অবস্থায় নিজেকে জাল থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে আধমরা অবস্থায় জালের সঙ্গে ঝুলে আছে।
বাগান মালিক ছিদ্দিক খান বলেন, বড়ই রক্ষার জন্য বাগান জাল দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। খোলা থাকলে পাঁকা কাচা বড়ইগুলো পাখি খেয়ে ফেলে। তাই এ ফাঁদ দেওয়া হয়েছে।
হারুন তালুকদার বলেন, বড়ই বাগান জাল না টানিয়ে চাষ করা যায় না। জাল না থকলে সব বড়ই পাখি খেয়ে ফেলবে। তাতে আমাদের আসল টাকাও উঠানো যাবে না।
চুনাখালী গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, বিভিন্ন ফসল রক্ষার জন্য আমাদের পরিবেশে কিছু উপকারী পাখি রয়েছে। সে গুলো ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফসল রক্ষা করে থাকে। যে ভাবে বড়ই বাগানের জালে উপকারী পাখি মারা যাচ্ছে তাতে অদুর ভবিষ্যতে ফসল রক্ষার জন্য উপকারী পাখি খুজে পাওয়া যাবে না। ফলে আমাদের পরিবেশসহ ফসল রক্ষায় বিপর্যয় নেমে আসবে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এনএস এর নির্বাহী পরিচালক শাহাবুদ্দিন পান্না। তিনি বলেন, পাখিদের নিধন রোধ করতে আইনের প্রয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বড়ই বাগানের জালে যে ভাবে পাখি নিধন করা হচ্ছে তাতে এ অঞ্চলে ধানের ফলন মৌসুমে ধানসহ বিভিন্ন ফসল কম উৎপাদন হবে। এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। এভাবে পাখি হত্যার হাত থেকে পাখিদের বাঁচাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ তালতলীর সমন্বয়ক আরিফুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বাগানে ফল রক্ষার জন্য পাতা কারেন্ট জালে আটকা পড়ে প্রতিনিয়তই প্রাণ হারাচ্ছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের পাখি। পাখি ও অন্যান্য প্রাণীদের হাত থেকে বরই রক্ষার জন্য তারা কারেন্ট জাল দিয়ে বাগানটিকে ঘিরে ফেলেন। এরপর থেকে ওই বাগানের উপর দিয়ে কোনো পাখি যাওয়ার মাত্রই জালে আটকা পড়ে মরে ঝুলে থাকে।
আমতলী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাখি বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আনম আমিনুর রহমান বলেন, বড়ই বাগানের জালে আটকা পরে উপকারী পাখি মারা যাচ্ছে এটা আইনে অপরাধ। যে হারে জালে আটকা পরে পরিবেশের উপকারী পাখি মারা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে ধানসহ বিভিন্ন ফলন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এছাড়া ব্যাপক হারে পাখি নিধনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পরিবেশের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
এসএম