ঢাকা, শনিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন জুয়েলের সঙ্গী সুমন

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২০
হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন জুয়েলের সঙ্গী সুমন হাসপাতালের বেডে আহত সুলতান রুবায়াত সুমন। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: ঘটনার পাঁচ দিন পরে এখনও মাঝেমধ্যেই আঁতকে উঠছেন লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে জুয়েল নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া নিহত জুয়েলের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমন (৫১)।  

থেকে থেকেই কান্না করেন বিভৎস সেই ঘটনার দৃশ্য মনে করে।

চিকিৎসকরা সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে কোনোকিছু জানতে চাইলেই হাউমাউ করে কান্না করেন সুমন। বাড়ি ফিরতে চান বার বার।  

শারীরিকভাবে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন সুমন। পরিবারের সান্নিধ্যে পেলে মানসিকভাবেও শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে জানিয়েছেন সুমনের চিকিৎসকরা।

লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সার্জারি ওয়ার্ডে ৪৫ নম্বর বেডে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসা চলছে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সুলতান রুবায়াত সুমনের। তিনি রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি রংপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক।  

লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুল হাদি, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সাহেব আলী ও আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ দোলনের যৌথ তত্ত্বাবধানে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসা চলছে বুড়িমারীর নরকীয় ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া সুমনের।  

মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) সকালে সুমনের চিকিৎসা নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় তার চিকিৎসক লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ দোলনের।

অনেক চেষ্টা করেও সুমনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার চিকিৎসক লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ দোলন বাংলানিউজকে বলেন, গণপিটুনিতে আহত সুলতান রুবায়াত সুমনকে বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) মধ্যরাতে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। তার অবস্থা বুঝে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার সারা শরীরে মারধরের আঘাতের চিহ্ন। ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন সুমন। মাথার কেটে যাওয়া স্থানে সেলাই দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে সুমন শারীরিকভাবে অনেকটা সুস্থ। তবে তার সামনেই ঘটেছে বীভৎস ঘটনা। তাই মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। তাকে পরিবারের সান্নিধ্যে পাঠানো হলে দ্রুত মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন।  

শারীরিকভাবে সুস্থতা অনুভব করায় তাকে ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে। তবে তদন্তের স্বার্থে বা প্রশাসনিক প্রয়োজন শেষ হলে পুলিশ বাহিনী ছাড়পত্র নিতে চাইলে দ্রুতই ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে জানান ডা. মঞ্জুর মোর্শেদ দোলন।  

সুমনের চিকিৎসক আরো বলেন, চিকিৎসার স্বার্থে মানসিক অবস্থা জানতে চিকিৎসকরা তার মুখে সেই দিনের বীভৎস ঘটনার বর্ণনা জানতে চাইলেই সুমন শুধু কান্না করে। অদৃশ্য ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাই চিকিৎসকদের ধারণা মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য তাকে পরিবারের সান্নিধ্যে পাঠানো প্রয়োজন। পরিবারের লোকজন দেখা করেছেন কিছুক্ষণের জন্য। নার্স ও পুলিশ সদস্যরাই হাসপাতালে সুমনের দেখাশোনা করছেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে খুব শিগগিরই সুমনকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহিদুন্নবী জুয়েল (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয় জনতা। এ ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান নিহতের সঙ্গী সুলতান রুবায়াত সুমন।

নিহত শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রীপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ার পর থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি।

পুলিশ জানায়, কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে কিছু মানুষ জুয়েল ও সুমনকে গণপিটুনি দেয়। দ্বিতীয় হামলায় জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ পুড়িয়ে দেয়। পুলিশি সহায়তায় নিহতের সঙ্গী সুমনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম বাদী হয়ে পাটগ্রাম থানায় একটি হত্যা মামলা এবং পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় পাটগ্রাম থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী বাদী হয়ে একটি ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ওই ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। আলোচিত এসব মামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া সুলতান রুবায়াত সুমনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলাগুলো জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে হস্তান্তর করা হয়।

এসব মামলায় পুলিশ বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খাদেমসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে হত্যা মামলার পাঁচ আসামিকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মাহমুদুন্নবী। মঙ্গলবার তার শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।