ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

খেলা

হুইলচেয়ারে চেপে, কাঁধে চড়ে মাঠে মারুফ

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৭
হুইলচেয়ারে চেপে, কাঁধে চড়ে মাঠে মারুফ হুইল চেয়ারে চেপে খেলা দেখতে ক্রিকেট মাঠে মোস্তফা আল মারুফ

চট্টগ্রাম: জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পূর্ব গ্যালারির একেবারেই ওপরের দিকে। সারি সারি চেয়ারলাগোয়া দু’ভাঁজ করা একটা চার চাকার কালো হুইল চেয়ার। তার পাশেই গ্যালারি ভর্তি মানুষের ভিড়ে মিশে থাকা বছর চব্বিশের টগবগে তরুণ।

ছেলেটার পুরো চেহারাজুড়েই যেনো উচ্ছ্বাসের আবহ। দৃষ্টিরা পড়ে আছে কেবল ওই বাইশগজে।

এটাই যে তার প্রথম স্টেডিয়াম দর্শন।

নাম তার মোস্তফা আল মারুফ। ও হাঁটতে পারে না। 'জন্মগত প্রতিবন্ধী' যার পরিচয়!

দূর থেকে সাদা পাঞ্জাবি পরা মারুফকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি প্রতিবন্ধী। কিন্তু কাছে গেলেই স্পষ্ট। দু’টো পা একেবারেই ভিন্ন। পায়ের পাতা উল্টো দিকে ঘোরানো, হাঁটু থেকে পা নিচের দিকে নেমে গেছে বেশ অস্বাভাবিকভাবেই।

কিন্তু ক্রিকেট আবেগ কী এতো এতো সীমাবদ্ধতা মানে? বহুদিন থেকে মাঠে বসেই খেলা দেখার ইচ্ছেটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো মারুফের। হয়ে ওঠেনি একবারও।  

হবেই বা কীভাবে? নড়াচাড়াতেই যার অন্যের ওপর নির্ভরতা, তার আবার বহুদূরের পথ স্টেডিয়াম যাত্রা?

তবে বুধবার (২৯ নভেম্বর) তার সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করেছেন চাচাতো ভাই আর ভাগ্নে।

হুইল চেয়ারে চেপে স্টেডিয়ামের মুখ পর্যন্ত আসেন। পরে সেখান থেকে চাচাতো ভাই হাবিব আর ভাগ্নে তাজমির কোলে-কাঁধে করে তাকে গ্যালারিতে তোলেন।

রাতে (বুধবার) তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন বিপিএলের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স আর ঢাকা ডাইনামাইটসের খেলা চলছিল। তার প্রিয় খেলোয়াড় দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল আর পাকিস্তানি তারকা শোয়েব মালিকের খেলা দেখতে দেখতে আড্ডা জমতে থাকে মারুফের সঙ্গে।

চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলী ইউনিয়ের জাফরাবাদের আজগর আলী আর ফাতেমা আলী দম্পত্তির সাত সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মারুফ। অন্য ভাইবোনেরা স্বাভাবিক হলেও জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী মারুফ।

মারুফ বলেন, 'এর মধ্যেও স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার পায়ের বড় ধরনের অপারেশন করতে হয়। তখন চিকিৎসক পরামর্শ দেন দিনের প্রায় সময় রেস্টে থাকতে। এরপর আর মাদ্রাসায় যাওয়া হয়নি।  

ইচ্ছে থাকলেও মারুফের পড়ালেখার পাশে দাড়ি যতিচিহ্ন বসে যায় তখনি। পড়ালেখার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটেও বেশ ঝোঁক ছিল মারুফের।  

'নিজে খেলতে পারি না তা ঠিক। কিন্তু ক্রিকেট না দেখা ছাড়া আমার চলে না। '-নিজেকে নিয়ে সোজাসাপ্টা জবাব মারুফের।

'অনেকদিন ধরে মাঠে বসে খেলা দেখার ইচ্ছে ছিলো। অবশেষে প্রথমবারের মতো আসলাম। এই দিনটির কথা আমার মনে থাকবে সারাজীবন। বুধবারের রাতটা বোনের বাসায় কাটাবো। তারপর ঘরে ফেরা। ঘরে এবার অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত নিয়েই যাচ্ছি। '-আবেগ ফুরোয় না মারুফের।

স্টেডিয়ামে এসে স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি এটা যে তার জন্য 'যোগ্য' জায়গা নয় সেটাও বুঝে গেছেন মারুফ। স্বাভাবিক মানুষের জন্য সবকিছু থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ সুবিধাও যে নেই সেটা এড়ায়নি মারুফের চোখ।

তাই আফসোস মাখা কণ্ঠে বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী হয়েছি তাতে কি হয়েছে? আমাদেরও তো ইচ্ছে করে মাঠে বসে খেলা দেখার। মাঠে আমাদের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ রাখা যায় চাইলেই। যেখানে আমরা সরাসরি হুইল চেয়ারে চেপেই প্রবেশ করতে পারবো। এভাবে কাঁধে চড়ে আসতে হবে না।

শেষে ইংরেজিতে মারুফ বলে ওঠেন, 'হয়েন আই হ্যাভ এ ম্যানটাল অ্যাবিলিটি, সো নো ম্যাটার দ্য ডিজঅ্যাবিলিটি। '

মারুফের এই কথাটি যেনো বড় দামি। তার মনের জোর জারি থাকুক....

বাংলাদেশ সময়: ০২১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৭
টিএইচ/জেডএস/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।