পেশায় সাংবাদিক। আগরতলা থেকে প্রকাশিত একটি প্রভাতী দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক।
১০৭০ সালে তার ১৮ বছর বয়স। সবেমাত্র মেট্রিক পাস করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জের বিরাহিমপুর গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে আগরতলায় চলে এসেছেন। তার কয়েক মাস পরই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। তখন আগরতলার মহারাজা বীরবিক্রম কলেজটিলায় ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। যারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক তারা এখানে গিয়ে যোগ দিতেন। এখান থেকে তাদেরকে অন্যান্য জায়গায় ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো। আবার ট্রেনিং শেষে তারা কলেজ টিলার ক্যাম্পে আসতেন। এরপর তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন শিবিরে পাঠানো হতো। মূলত কলেজটিলার শিবিরটি ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তখন রাজধানী আগরতলার স্থায়ী বাসিন্দা অনেক যুবক কলেজ টিলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজকর্ম দেখতেন। তা দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই এই যুদ্ধে সামিল হতেন।
পিযুষ চক্রবর্তী লক্ষ্য করেন তার আগরতলার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং নিতে চলে গিয়েছে। এর মধ্যে একদিন কলেজ টিলার ক্যাম্পে গিয়ে দেখেন যে তৎকালীন নোয়াখালি জেলার কোম্পানীগঞ্জের এক মামা এখানে এসেছেন ট্রেনিং নিতে যাবে অন্য কোথাও। তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কলেজ টিলা ক্যাম্প থেকে তাদেরকে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাঠানো হয় অসম রাজ্যের উত্তর কাছাড় হিল জেলার হাফলং এলাকায়। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী এস এস বি ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়। তারা প্রায় ৩শ' জন এক সঙ্গে ট্রেনিং নেন। এই প্রশিক্ষণে এল এম জি সহ আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছেন, যারা শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ এবং যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা পাস করে বেরিয়েছেন। এইভাবে তিন ভাগকে আলাদা আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে পাঠানো হয় ত্রিপুরার দক্ষিণ জেলার চুত্যাখলার বেস ক্যাম্পে। সেখান থেকে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ অথবা অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আসে সেই আসল সময়। তাদেকে পাঠানো হয় বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে।
পিযুষ চক্রবর্তীর এখনো স্পষ্ট মনে আছে, তখন রমজান মাস চলছিলো ভোরের আবছা অন্ধকারে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশে প্রবেশের সময় প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তাদের। জলাজায়গার মধ্যে কয়েকটি বাড়ি ছিলো। তারা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেন। তাদের কমান্ডার ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান সড়ক ও সেতুমন্ত্রী তথা আওয়াম লীগ নেতা ওবায়দুর কাদের। এখান ক’দিন থাকার পর আরো প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কিমি দূরে কোম্পানীগঞ্জে গিয়ে পৌঁছান তারা।
সেখানে যাওয়ার পর ১৪ জন সদস্যের একটি সেকসন, ৪২ জন মিলে হয় প্লাটুন ও ১২৬জনে একটি কোম্পানি। প্রতিটি থানা এলাকায় একটি করে সেকশনে ভাগ হয়ে গেরিলারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যান। সেই সঙ্গে চলতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে চোরাগুপ্তা হামলা। তবে এক জায়গায় বেশি দিন থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ রাজাকার বাহিনীর সদস্যরাও নজর রাখছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধির্ ওপর।
তিনি জানান, এই যুদ্ধে তাদের এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বাড়ির পুরুষ সদস্য/ সদস্যরা রাজাকার বাহিনীর সদস্য, অথচ মহিলাটি/মহিলারা তাদেরকে ভাত খেতে দিয়েছেন। পানি খেতে দিয়েছেন। অনেক সময় অনেক বাড়ির মহিলারা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে বোরখা পরিয়ে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন।
তাদেরকে বলা হয়, খুব হিসেব করে গুলি খরচ করতে। পাকসেনারা ২০টি গুলি চালায় তাহলে তারা যেন একটি গুলি চালায়। আর সেই সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন একটি গুলিতে শত্রু পক্ষের একজনকে শেষ করা যায়। এর কারণ মুক্তিবাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত গুলি রাখা সম্ভব ছিলো না। আবার গুলি শেষ হয়ে গেলে গুলি নিতে বেস্ ক্যাম্পে আসাটাও সমস্যার ছিলো। এই সকল কারণে হিসাব করে গুলি, বারুদ খরচ করতে হতো তাদের।
মূলত তারা বেড়িবাঁধের ধারে রাস্তার পাশে নিচু জায়গায় অ্যাম্বুশ করে বসতেন পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের রাস্তায় ও পাকিস্তানি বাহিনী সামনে এলে অতর্কিতে হামলা চালাতেন। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার জওয়ান যেমন মারা গেছে, তেমনি তাদের সেকশনের বহু গেরিলা যোদ্ধাও শহীদ হয়েছেন। বলছিলেন পিযুষ চক্রবর্তী।
তখন যানবাহনের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হতো পায়ে হেঁটে। তাছাড়া তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দলের সঙ্গে অন্যদলের খবর আদান প্রদানের জন্য ভরসা ছিলো সাধারণ মুক্তিকামী জনগন। তারা খবর, প্রয়োজনীয় ঔষধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক একদিন ৪০ থেকে ৫০কিমি রাস্তাও পায়ে হেঁটে যেতেন। সকলের চেষ্টায় আসে সাফল্য। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ। নতুন দেশ জন্ম নেওয়ার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধারা আগ্নেয়াস্ত্র জমা করেন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় "স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদ" প্রদান করে। পিযুষ চক্রবর্তীও পেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের স্বীকৃতির সনদ। তবে তাকে বাংলাদেশি হিসবেই তিনি পান সেই বীরত্বের সনদ। পরে দেশান্তরী হয়ে ভারতের তি্রিপুরায় সপরিবারে পাড়ি জমালেও তার জন্মভূমি তো বাংলাদেশই। তাই এখনো তার বুক জুড়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৭
এসসিএন/জেএম