ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আগরতলা

আয়েশি, অদূরদর্শী নেতৃত্বেই ত্রিপুরায় বাম বিপর্যয়!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৮
আয়েশি, অদূরদর্শী নেতৃত্বেই ত্রিপুরায় বাম বিপর্যয়! দ্য হিন্দু’র ত্রিপুরা প্রতিনিধি সিনিয়র সাংবাদিক সাজ্জাদ আলী। ছবি-বাংলানিউজ

আগরতলা: রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিপুরায় বিজেপি প্রথমবারের মতো বাম দুর্গ ধসিয়ে দিয়েছে। বামশাসিত রাজ্যটিতে কাস্তে হাতুড়িকে হটিয়ে উড়েছে তাই গেরুয়া ঝাণ্ডা। কিন্তু কেন? সেটাই এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

ত্রিপুরা রাজ্যের মোট বিধানসভা আসন ৬০টি। এসবের মধ্যে ২০টি আসন অনগ্রসর পাহাড়ি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত।

বিধানসভার ৬০ আসনের মধ্যে ৫৯টি আসনের ভোট গ্রহণ হবার পর জয়ী দল বিজেপি সরকার গঠন করেও ফেলেছে। তবে একটি আসনে ভোটগ্রহণ এখনো বাকি। এটি জনজাতির জন্য সংরক্ষিত চড়িলাম আসন। এই আসনের জন্য ভোট হবে ১২ মার্চ। এতেও বি জে পি'র জয় হবে বলে মত রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের।

এই জনজাতির জন্য সংরক্ষিত ভোট-হওয়া১৯টি আসনের ১৭টিতেই জয়ী হয়েছে বিজেপি-আইপিএফটি জোট। আইপিএফটি জনজাতির সংরক্ষিত ৯টি আসনে লড়ে ৮টিতে জয়ী হয়েছে। আর বিজেপি ১০টিতে লড়ে জয়ী হয়েছে ৯টিতে।

ভারতের নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে যে, এই জনজাতি সংরক্ষিত আসনগুলোতেই এবার নির্বাচনে বিজেপি বিধায়করা ন্যূনতম ৫৩ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বিজেপির এই উত্থান অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর।

অথচ ২০১৩ সালের ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে এই ২০টি জনজাতি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ১৯টিই পেয়েছিল বামফ্রন্ট। কি সেই কারণ যার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের দীর্ঘদিনের সঙ্গ ছেড়ে প্রায় সব জনজাতি অংশের মানুষ বিজেপির মতো কট্টর একটি রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়লো?বিজেপির  সহযোগীদল আইপিএফটি'র দিকে ঝুঁকে পড়লো?

ভারতের অন্যতম পরিচিত প্রভাতী ইংরেজি দৈনিক "দ্য হিন্দু"র ত্রিপুরা প্রতিনিধি সিনিয়র সাংবাদিক সাজ্জাদ আলী। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। বামফ্রন্টের এই বিপর্যয় সম্পর্কে বাংলানিউজের তরফ থেকে তার অভিমত জানতে চাওয়া হয়। তিনি কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন।  

তার মতে, প্রথম কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা সাংগঠনিক ক্ষয়। বামফ্রন্টের সাবেক ও প্রয়াত নেতা দশরথ দেব, সুধন্য দেববর্মা, অঘোর দেববর্মা, নৃপেন চক্রবর্তী, বীরেন দত্ত প্রমুখ নেতারা দিনের পর দিন ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র জনজাতি অংশের মানুষে সঙ্গে থেকেছেন। তাদের দাবিতে লড়াই আন্দোলন করেছেন।

সাজ্জাদ আলী মনে করেন, তাদের এই জনঘনিষ্ঠতার কারণেই বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআই (এম) ঐ সকল পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠির মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল। এই নেতারা জনজাতি অংশের মানুষের জন্য লাগাতার গণআন্দোলন চালিয়ে গেছেন, লড়ে গেছেন। কিন্তু সিপিআই(এম) দলের বর্তমান নেতাদের সেই রকম জনঘনিষ্ঠতা ও জনদরদ নেই। তারা এসব অবহেলিত বঞ্চিত দরিদ্র মানুষদের জন্য তেমন কোনো  কর্মসূচী, তেমন কোনো অবদান বা দরদ এখনকার নেতাদের নেই। গত প্রায় এক দশক ধরে গণবিচ্ছিন্নতা, এই জনসংযোগহীনতা ও জনবিমুখতা দেখা দিতে থাকে এবং পরে তা  প্রকট হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি সি পি আই (এম) দলের নেতারা জনজাতি অংশের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতাদের দায়িত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নেতাদেরকে দলের জনজাতিভিত্তিক শাখা সংগঠন "ত্রিপুরা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ"(জি এম পি)-এ স্থান দেওয়া হয়েছে। এমনকি সিপিআই (এম) দলের রাজ্য নেতৃত্বেও অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নেতাদেরকেই স্থান দেওয়া হয়েছে। এই কারণে বর্তমান জিএমপি নেতারা আগের নেতৃত্বের মত পাহাড়ে এবং জনজাতি অংশের মানুষের মধ্য জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারননি। সেই সঙ্গে যে ক্ষয় ও জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হয় তা আটকানো যায়নি।

ত্রিপুরা রাজ্যের জনজাতিদের উন্নয়নের জন্য 'ত্রিপুরা আদিবাসী স্বশাসিত জেলা পরিষদ' গঠনের পর মাঝে কিছু দিন অন্য দল ক্ষমতায় থাকলেও বামফ্রন্ট সব চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু সিকি শতাব্দিকাল ক্ষমতায় থেকেও জনজাতি অংশের মানুষের, অবহেলিত দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বা ভাগ্যবদলে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকাই পালন করেনি তারা। তারা পশ্চাৎপদ জ৮নজাতির মানুষসহ সমাজের দরিদ্র অংশটিকে কেবল ভোটব্যাংক হিসেবেই ব্যবহার করে গেছে। উল্টো স্বশাসিত জেলা পরিষদে বামেরা করে গেছে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম। এজন্য মানুষের মনে পুঞ্জিভূত হচ্ছিল হতাশা, অতৃপ্তি ও ক্ষোভ। সাধারণ জনজাতি অংশের মানুষের মধ্যে সৃষ্ট তীব্র এই ক্ষোভ-অসন্তোষই এবার তরীঢ ডুবিয়েছে বামদের। বামের বিকল্প হিসেবে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবেই তারা বিজেপি নামের বিকল্পকে বেছে নিয়েছে।

সেই সঙ্গে বাঙালি মানুষের মত জনজাতি অংশের মানুষের মধ্যেও কর্মহীনতার বিষয়টি প্রকট ছিল। সব শেষ কারণটি হলো বিজেপি'র নির্বাচনী জোটসঙ্গী আইপিএফটি দল নির্বাচনী জোটের শর্ত অনুসারে ত্রিপুরা রাজ্যকে ভেঙ্গে পৃথক টিপরাল্যান্ড রাজ্যের দাবির বিষয়টি চেপে গেলেও পাহাড়ে তারা মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলো যে, তাদের টিপরাল্যান্ড রাজ্য গঠনের আন্দোলন জারি থাকবে।

জনজাতি অংশের মানুষের মধ্যে একটি ধারণা কাজ করে যে, উত্তরপূর্ব ভারতের মধ্যে ত্রিপুরাই একমাত্র রাজ্য যেখানে বাংলাভাসী মানুষের কারণেই জনজাতি অংশের মানুষ তাদের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার থেকে  বঞ্চিত। তাই যখনই পৃথক রাজ্যের কথা ওঠে, তখনই জনজাতি গোষ্ঠির একটি অংশ, বিশেষ করে যুবক তরুণরা সব কিছুর উর্ধ্বে টিপরা ল্যান্ডের দাবির সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

বামফ্রন্ট তথা সিপিআই (এম) দলের এই দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে বিজেপি কাজ করেছে এবং আইপিএফটি দলকে সহযোগিতা করেছে। এসব নানা কারণে, নানা ভুল, অবহেলা আর অতিরিক্ত আত্মতুষ্টির মনোভাবের কারণে এবার বামফ্রন্টের বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে করেন সাজ্জাদ আলি।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮
এসসিএন/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।