চাঁদপুর: চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর প্রায় ৭০ কিলোমিটার নৌ-সীমানার বেশ কয়েকটি এলাকায় ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে হাইমচর, মাঝেরচর, আলুবাজার, মোহনপুর ও ষাটনল এলাকায় অধিকাংশ সময় এসব ঘটনা ঘটে।
চাঁদাবাজির শিকার ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা চাঁদাবাজি করতে আসে না এবং চাঁদার পরিমাণও নির্দিষ্ট নেই। তবে সর্বনিম্ন ২ হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা আদায় করেন চাঁদাবাজরা।
এদিকে, এসব এলাকার চাঁদাবাজি ও ডাকাতির সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্য নেই নৌ-পুলিশের কাছে।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) হাইমচর উপজেলার কাটাখালি, সদরের হরিণা ফেরিঘাট এলাকার নৌযান শ্রমিক, মালিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বরিশাল হিজলা উপজেলার নৌযান মালিক কুদ্দুছ বেপারী। তিনি গত ২০ বছর এই ব্যবসায় জড়িত। তার ৫টি স্টিল বডি পণ্যবাহী ট্রলার আছে।
তিনি বলেন, হিজলা থেকে চাঁদপুরের হাইমচর, কাটাখালি, আলুবাজার এলাকায় আমার পণ্যবাহী ট্রলারগুলো চলাচল করে। এসব এলাকার মধ্যে আলুবাজার এলাকায় বেশিরভাগ চাঁদা দিতে হয়। নদীতে যারা চাঁদাবাজি করে তাদের বয়স ১৮-২০ বছর। তারা আমাদের ট্রলারের শ্রমিকদের কাছ থেকে যখন যা পায় তা নিয়ে যায়।
চাঁদার পরিমাণ কমপক্ষে ২ হাজার টাকা জানান তিনি।
কুদ্দুছ বেপারী আরও বলেন, তাদেরকে (চাঁদাবাজ) জিজ্ঞাসা করা হয় কীসের চাঁদা। তারা বলে আমরা এই এলাকা নদী পাহারা দিয়ে রাখি। এছাড়াও গত বছর আলুবাজার এলাকায় আমার একটি ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। ওই সময় ট্রলারে থাকা একটি নতুন ইঞ্জিনসহ প্রায় ১ লাখ টাকার জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং ট্রলারে থাকা শ্রমিকদের কুপিয়ে আহত করে।
হিজলা এলাকার ট্রলারের শ্রমিক সাইদুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজরা টাকা না পেলে আমাদেরকে মারধর করে। নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ড টহলে থাকলে ভালোভাবে চলাচল করা যায়। আর যখনই এলাকা নিরিবিলি থাকে, তখনই চাঁদাবাজরা আসে।
হাইমচর কাটাখালি লঞ্চঘাট এলাকার ইট-বালু ব্যবসায়ী মহসিন মিয়া বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে পণ্যবাহী ট্রলার আসে বরিশাল থেকে। বরিশাল থেকে চাঁদপুরে আসার পথে মাঝেরচর ও হিজলা এলাকায় অনেক সময় জাহাজ ও ট্রলার আটকে চাঁদা দাবি করা হয়।
চাঁদাবাজদের অধিকাংশ জেলে বলে দাবি করেন তিনি।
মহসিন মিয়া বলেন, জাহাজের প্রপেলরে জাল কাটা পড়েছে এমন অভিযোগে চাঁদা দাবি করেন এসব জেলেরা। অনেক সময় জেলেরা আমাদের কাছে এসে এসব বিষয়ে অভিযোগ করেন। তখন ট্রলার ও জেলেদের মধ্যে বসে বিষয়গুলো সমাধান করা হয়।
চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী এমভি রাব্বানা-২ লাইটার জাহাজের মাস্টার মো. জাহাঙ্গীর বলেন, চট্টগ্রাম-ঢাকা নৌ রুটের বেশ কয়েকটি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে চাঁদপুরের হাইমচর, মাঝেরচর ও মতলবের ষাটনল এলাকায় চাঁদাবাজি বেশি হয়। কোনো নির্দিষ্ট লোক চাঁদাবাজি করতে আসে না। একেক সময় একেক লোক আসে। তারা জাহাজের লোকদের কাছে যখন যে পরিমাণ টাকা পায় তাই নিয়ে চলে যায়।
খোঁজ নিয়ে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল এলাকায় নৌযানে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দেন রিপন সরকার ও তার ভাই নয়ন সরকার। তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায়। নয়ন সরকারের নামে মুন্সীগঞ্জসহ আশপাশের থানায় ৭টি ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা আছে। এসব মামলায় তিনি একাধিকবার জেল খেটেছেন। নয়নের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ হলেও তিনি চাঁদপুরের মতলব উত্তর এলাকায় তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে অবস্থান করেন।
এই বিষয়ে কথা বলার জন্য রিপন সরকারের মোবাইলফোন নম্বরে একাধিকবার কলা করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে মেসেজ পাঠানো হলেও উত্তর পাওয়া যায়নি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
মোহনপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি এই ফাঁড়িতে দেড় মাসে আগে যোগদান করেছি। বিগত দিনের চাঁদাবাজি কিংবা ডাকাতির তথ্য আমার কাছে নেই। তবে চলতি মাসের ১ তারিখে নৌযানে ডাকাতির সময় মেঘনা নদীর চরউমেদ নামক স্থান থেকে ৩ জন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন - শাহ আলম বেপারী, মোক্তার মোল্লা ও সুমন বেপারী। তাদের বিরুদ্ধে মতলব উত্তর থানায় মামলা হয়েছে এবং তারা বর্তমানে চাঁদপুর কারাগারে আছেন।
চাঁদপুর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএমএস ইকবাল বলেন, আমি এই থানায় নতুন যোগদান করেছি। নদী এলাকায় চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনায় অনেক আসামি আটক হয়েছে এবং অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। তবে এসব তথ্য দিতে হলে সময় লাগবে। তবে নৌ পথের নিরাপত্তার জন্য আমাদের সার্বক্ষণিক টহল অব্যাহত আছে।
কোস্টগার্ড চাঁদপুর স্টেশনের গোয়েন্দা অফিসার মো. মামুন বলেন, বিগত বছরগুলোতে যেসব ডাকাতি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় আমাদের অভিযান হয়েছে এসব তথ্য আমাদের হেডকোয়ার্টারে আছে। এ সংক্রান্ত তথ্য নিতে হলে ঢাকায় যোগাযোগ করতে হবে। তবে সর্বশেষ গত ১৯ ডিসেম্বর কোস্টগার্ড চাঁদপুর স্টেশনের টহল সদস্যরা মেঘনা নদীর মতলব উত্তরে অভিযান চালায়। এ সময় ডাকাত দল অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে স্পিড বোট রেখে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্পিড বোট এবং স্পিড বোটে থাকা একটি একনলা বন্দুক, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা, পাঁচটি ছুরি ও দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করে। এই ঘটনায় চাঁদপুর নৌ থানা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
কোস্টগার্ড চাঁদপুর স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফজলুল হক বলেন, মূলত নৌপথ নিরাপদ রাখার জন্য মূল কাজটি করে নৌ পুলিশ। পাশাপাশি আমরাও কোস্টাল এরিয়ায় নিরাপত্তার জন্য কাজ করি। তবে গত কয়েকদিন আগে জাহাজে ৭ খুনের পর টহল আরো জোরদার করা হয়েছে। এছাড়াও চাঁদপুর নৌ এলাকায় নিরাপত্তা বাড়াতে কোস্টগার্ডের বহরে আরো একটি নতুন জাহাজ এই এলাকায় অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪
এসএএইচ