ঢাকা: নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাবেক তিন সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান ও নজরুল ইসলাম বাবুর পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে ধনী হয়েছে ফকির গ্রুপ।
পোশাক খাতের এ প্রতিষ্ঠানে এ তিন সাবেক এমপি বিপুল অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে শফিকুল ইসলাম শফিক ও মো. বাবুল নামে দুজনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে ফকির গ্রুপের তিন কর্ণধারকে আসামি করে মামলা করা হয় গত ২২ আগস্ট। ওই দুই মামলার প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মামলায় ফকির নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান, তার ভাতিজা ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ ও ফকির গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামানকে অর্থ জোগানদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত শফিকুল ইসলামের ভাই জহিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার ভাইকে হত্যার ঘটনায় ফকির গ্রুপের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
তাদের আসামি করার পর টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন ফকির গ্রুপের একাধিক কর্মকর্তা। কিন্তু আমরা অর্থ নেইনি। যারা অর্থ দিয়ে, শক্তি দিয়ে আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই। তারা এখন হুমকি দিচ্ছে।
সাবেক তিন আওয়ামী এমপির সঙ্গে মিলেমিশে জমি দখলসহ বহু অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে ফকির গ্রুপের এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বারবার প্রতিবাদে নেমেছিল স্থানীয়রাও। সন্ত্রাসী বাহিনী প্রতিবাদকারীদের প্রাণহানির হুমকিও দিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ফকির গ্রুপের অপকর্মের বিচার চাইতে শুরু করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
সংগীতশিল্পী ইভা রহমানকে জিম্মি করে রাজধানীর গুলশানে ১৮ কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট দখলে নিয়েছেন ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান।
আক্তারুজ্জামানকে প্রধান আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করেছেন ইভা। মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক দুই দাপুটে এমপি শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবুসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ইভা গত ২৮ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। ইভার অভিযোগ—আওয়ামী লীগের এই সাবেক এমপিদের ইন্ধনে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে (বাবুর নির্বাচনী এলাকা) দীর্ঘদিন ধরে ভূমিদস্যুতা চালিয়ে আসছে ফকির গ্রুপ। স্থানীয় মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়ে অবৈধভাবে জমি দখল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফকির আক্তারুজ্জামানকে স্বৈরাচারীর কালো হাত হিসেবে অভিহিত করে ইভা বলেছেন, এই ফকির আক্তারুজ্জামান ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার অর্থ মজুদকারী, বিদেশে অর্থ পাচারকারী। নিজের অর্থায়নে বাড়ির কাজ শেষ করেছিলেন ইভা। ফকির আক্তারুজ্জামান ৪৬ লাখ টাকা করে দুটি ফ্ল্যাটের ৯২ লাখ টাকা দেন ও কাজ শেষে বাকি অর্থ পরিশোধের কথা দিয়েছিলেন। ইভা অভিযোগ করেছেন, কাজ শেষ হওয়ার পর অর্থ না দিয়ে ইভা ও তার সন্তানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জীবননাশের হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক ফ্ল্যাট দুটি দখল করে নেন ফকির আক্তারুজ্জামান। পরে পুরো বাড়ি দখলে নিতে চেষ্টা চালান। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই মাজহারুল ইসলাম গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত কার্যক্রম চলমান। প্রধান আসামি ফকির আক্তারুজ্জামান ও অন্য আসামিদের খোঁজা হচ্ছে। অধিকাংশ আসামিই পলাতক।
নারায়ণগঞ্জে গত আওয়ামী আমলে ফকির গ্রুপের ব্যবসার পরিধি ব্যাপকভাবে ঘটেছে। ফতুল্লার কায়েমপুরে ফকির নিটওয়্যারস, বিসিকে ফকির এ্যাপারেলস, রূপগঞ্জের ডহওরগাঁওয়ে ফকির ফ্যাশন, বরপায় ফকির স্পিনিংসহ বিভিন্ন স্থানে ফকির সাম্রাজ্য বাড়তে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফকির গ্রুপের ফকির নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান, ফকির এ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মনিরুজ্জামানের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর ও বন্দর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর সখ্যতা ছিল গভীর। শহর নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও ফতুল্লা, রূপগঞ্জ ও নিজ উপজেলা আড়াইহাজারে অঘোষিত শাসক ছিল ফকির গ্রুপের কর্ণধাররা। এই গ্রুপ নামে-বেনামে কিনে নেয় শত শত বিঘা জমি। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ জমিই নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অসহায় মানুষের জমি দখলে ব্যবহার করা হয় সন্ত্রাসী বাহিনী।
স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানান, ফকির আক্তারুজ্জামান, তার ভাতিজা ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ব্যবসায়ী অংশীদার। তাদের সঙ্গে বাবু নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বহু প্রতিষ্ঠান। রূপগঞ্জের বরপায় বাবু ফকির আক্তারুজ্জামানের মাধ্যমে একটি স্পিনিং মিল ১২০ কোটি টাকায় কিনে অংশীদার হন। ফতুল্লার কায়েমপুরে ফকির নিটওয়্যারেও বাবুর অংশ রয়েছে। এমনকি রূপগঞ্জের ফকির গার্মেন্টসে অংশ রয়েছে বাবুর। একই সঙ্গে ফকির আক্তারুজ্জামান ও ফকির মনিরুজ্জামানের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের বিপুল অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। বন্ড সুতার আড়ালে চোরাই সুতার ব্যবসা করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তা বিদেশে পাচারও করা হয়। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় ওসমান পরিবারের সদস্য ও সাবেক এমপি সেলিম ওসমানের দুটি আলিশান বাড়ি কিনে নেয় ফকির গ্রুপ।
সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার কায়েমপুর গিয়ে দেখা যায়, বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ফকির নিটওয়্যারস। এলাকার ফজল মিয়া বলেন, কারখানাটি প্রথমে ছোট ছিল। পরিধি বেশি বেড়েছে গত এক যুগে। রূপগঞ্জের ডহওরগাঁওয়ে কয়েকশ বিঘায় গড়ে উঠেছে ফকির ফ্যাশন। কারখানা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে পাঁচরুখীতে শত কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয়েছে আলিশান বাড়ি। আড়াইহাজার বাজারে থানার সামনেই উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতা কার্যালয়ে হামলা চালায়। সেখানে আলাপকালে উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক এমপি বাবু আড়াইহাজারের মানুষকে জিম্মি করে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। আর সেই টাকা নিরাপদে বিনিয়োগ করেছেন ফকির গ্রুপে।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জাকারিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে ফকির গ্রুপ।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পাঁচরুখী, বিষনন্দী, কড়ুইতলা, চালাকচর, টেটিয়া, পাথরঘাট, ঝাঁওপাড়া, কামরাঙ্গী চর, দাসপাড়া, ছনপাড়া, বরপায় সাবেক এমপি বাবুর সহযোগিতায় বিপুল জমি দখল করেছে ফকির গ্রুপ। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ শহর, মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ও ময়মনসিংহের ভালুকায় এ গ্রুপের জমি রয়েছে। বিষনন্দী ফেরীঘাটের পার্শ্ববর্তী চিলার চর মেঘনা নদীর পারে কথা হয় স্থানীয় গ্রামবাসী বশির আহমেদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ফকির গ্রুপ আড়াইহাজারের বিভিন্ন পয়েন্টের মূল্যবান জায়গাগুলো নামমাত্র মূল্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল করে নিয়েছে। জায়গা দিতে রাজি না হলে মামলা দিয়েও হয়রানি করা হয়েছে।
মো. হারুনুর রশিদ জানান, আমার নানির ১০০ শতাংশ জমিও জোরপূর্বক নিয়ে গেছে। কোনো টাকাও দেয়নি। স্থানীয় সন্ত্রাসী কবির সানী, মঞ্জু, সিরাজ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আমাদের নির্যাতন করা হয়েছে। আড়াইহাজার উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইউসুফ আলী ভূইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক এমপি বাবুর প্রশ্রয়ে বেপরোয়া ছিল ফকির গ্রুপের লোকজন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তারা এখন আড়াইহাজার ও নারায়ণগঞ্জের পলাতক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার কাজ করছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জাঈদ হাসান রুজেল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার কিছু টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আবার কিছু টাকা মুখোশধারী ব্যবসায়ীদের কাছে রয়েছে। এ টাকা ভবিষ্যতে দেশে অরাজকতা ও নাশকতা সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হবে।
তারা জবাব দিতে চান না: অভিযোগের ব্যাপারে জানতে শনিবার বিকেল সোয়া ৩টায় ফকির নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামানের ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিকবার কল ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে রোববার ও মঙ্গলবার একাধিকবার ফোন কল ও খুদে বার্তা দেওয়া হয়। তাতেও সাড়া মেলেনি।
গত শনিবার দুপুরে ফকির অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মনিরুজ্জামানের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরের দিন রোববার মোবাইল নম্বর খোলা পাওয়া গেলেও কল রিসিভ করেননি তিনি। খুদে বার্তারও কোনো সাড়া দেননি। একইভাবে মঙ্গলবার বেশ কয়েকবার কল ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। গত শনিবার দুপুরে মনিরুজ্জামানের একান্ত সচিব মোক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী। আমি স্যারদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না। তাকে অভিযোগের বিষয়ে অবহিত করে মনিরুজ্জামানের বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করলে জানান, স্যার ব্যস্ত আছেন। পরবর্তী সময়ে একাধিকবার কল করা হলেও তিনিও জবাব দেননি। এভাবে ফকির গ্রুপের আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় শুনে কল কেটে দেন। পরবর্তী সময়ে আর কেউ কল রিসিভ করেননি।
তবে শেষ পর্যন্ত ফকির অ্যাপারেলসের এজিএম (প্রশাসন) জাকির মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, সাবেক এমপি নাসিম ওসমান, শামীম ওসমান ও নজরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে আমাদের গ্রুপের কোনো ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিল না, এখনো নেই। ফকির গ্রুপের মালিকরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তারা ব্যবসায়ী।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৫