ঢাকা, রবিবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৯ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

রাজা গিলছেন হাইল হাওর

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৬
 রাজা গিলছেন হাইল হাওর

হাইল হাওর দখল করে নতুন সাম্রাজ্য গড়েছেন গোলাম মোস্তফা রাজা। এজন্য শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাষট্টি বিলের ৬১.১২ একর জমি দখল করে নিয়েছেন এই ‘নব্য রাজা’।

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে: শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওর দখল করে নতুন সাম্রাজ্য গড়েছেন গোলাম মোস্তফা রাজা। এরই মধ্যে এই ‘নব্য রাজা’ হাওরের বাষট্টি বিলের ৬১.১২ একর জমি দখল করে নিয়েছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, হালের এই রাজার কাছে নিজেকে স‍ঁপে দিয়েছে মৌলভীবাজার প্রশাসনও। প্রায় দুই দশক ধরে সরকারের কয়েক কোটি টাকার সম্পদ জবরদখল করে রাখলেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। অভিযোগ রয়েছে, মাসোহারা আদায়ের কারণেই সবকিছু জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

নব্বই দশকের শুরুতে ঢাকা-শ্রীমঙ্গল হাইওয়ে থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে স্বল্প পরিসরে দখল শুরু করে এখন পুরো বিলই গিলে খেতে বসেছেন গোলাম মোস্তফা রাজা। বছর বছর নতুন এলাকা চলে যাচ্ছে তার কব্জায়। এরই মধ্যে ৬১.১২ একর খাসজমি দখল করে ফেলেছেন তিনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যক্তিগত সামান্য জমিতে ‘রাজারবাগ ফিসারিজ অ্যান্ড হ্যাচারি প্রাইভেট লিমিটেড’ গড়ে যাত্রা শুরু হয় রাজার। এরপর শুরু করেন খাসজমি দখল। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি গোপাট (গরুর পায়ে হাঁটা রাস্তা) ও লায়েকও (মানুষের পায়ে হাঁটা রাস্তা)। হাওর-বিল ও রাস্তার জমি দখল করে বাড়িয়ে চলেছেন তার এ সাম্রাজ্য (হ্যাচারি)। দিন দিন বড় হচ্ছে রাজার ফিসারিজ আর সংকুচিত হচ্ছে হাইল হাওর।

তবে সম্প্রতি ঘুম ভেঙ্গেছে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মৌখিক আদেশে তদন্তে নামেন শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের তহসিলদার। তাতে উঠে আসে ভয়ঙ্কর সব তথ্য।

তহসিলদার অসিত চন্দ দেব স্বাক্ষরিত ওই রিপোর্টে দেখা গেছে, এই ভূমিদস্যুর দখলে চলে গেছে সহিদপুর মৌজায় ৩৮২ দাগে গোপাটের জমি ৬.৬ একর, ৩৮৩ দাগে লায়েক পতিত জমি দশমিক ৭৮ একর, ৪০৯ দাগে বিলের জমি ৩.৪১ একর, ১০৮৫ দাগের জমি ১.০৭ একর এবং ১১৫৯ ও ১১৬০ দাগে বোরো চাষের জমি ১৩.৯৬ একর। ১০৯৮, ১০৮৯, ১০৮৫, ৪০৯ ও ৩৯৭ দাগে বাষট্টি বিলের ১১ দশমিক ২৭ একর জমিও বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন তিনি।

সব মিলিয়ে ৬১.১২ একর জমি চলে গেছে ভূমিদস্যু রাজার ভোগে। আর সেখানে মাছ চাষ করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাচ্ছেন তিনি। যে ‍কারণে কাউকেই আর পরোয়া করছেন না। টাকা দিয়েই সব কিনতে চাচ্ছেন।  

এমনকি একটি হত্যাকাণ্ডেও তার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সে যাত্রায় রক্ষা পান গোলাম মোস্তফা রাজা।

অভিযোগ রয়েছে, রাজার সাম্রাজ্যের এই বিশাল আয়ের একটি অংশ প্রশাসনের পকেটেও যাচ্ছে। যে কারণে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন নীরব রয়েছে সবকিছু জেনেও।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিশ্বজিৎ কুমার পাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার এখানে যোগদান করা বেশিদিন হয়নি। বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশে তহসিলদারকে রাজারবাগ ফিসারিজ অ্যান্ড হ্যাচারি প্রাইভেট লিমিটেডের বিষয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলি’।

‘তহসিলদার যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে দেখা গেছে, গত দশ বছর ধরে ৬১.১২ একর সরকারি জমি দখল করে রেখেছেন গোলাম মোস্তফা রাজা। রিপোর্টে আর্থিক ক্ষতি নিরুপণক্রমে তা আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে’।

তহসিলদারের রিপোর্টটি গত বছরের ১২ মার্চ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে (ভূমি অফিসের স্মারক নম্বর: ১০৯)। নিয়ম অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার রিপোর্টটি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে পাঠানোর কথা।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রিপোর্ট পাওয়ার পর নোটিশ করে উচ্ছেদ এবং অবৈধভাবে ভোগদখলের কারণে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা নেবেন।

এ বিষয়ে গোলাম মোস্তফা রাজার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাকে রং প্রশ্ন করছেন। আমি মোবাইলে কথা বলতে রাজি নই। আপনি সামনা সামনি আসেন, কথা বলবো’।

পরে তার সময় চাওয়া হলে বলেন, ‘আজকে সময় দেওয়া সম্ভব না’।
 
একদিন পর শুক্রবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে আবার ফোন করে হাইল হাওরের জমি দখল এবং তহসিলদারের রিপোর্টের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খানিকটা চটে যান রাজা। ‘আপনি কোথায় পেয়েছেন এ অভিযোগ? আমার কোনো বক্তব্য নেই’ বলেই ফোন কেটে দেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৬
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।