বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ কুলাউড়ায় নবীন চন্দ্র সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাখা হয়। এসময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
পরে বেলা ১১টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ভাষার জন্য সংগ্রাম করা মহীয়সী এ নারীর দাফন সম্পন্ন হয়। এসময় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বার্ধক্যজনিত কারণে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) জীবনের আলো নিভে যায় ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চুর। মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রওশন আরার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কুলাউড়ায় মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন, জেলা পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ, কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী, উপজেলা আ’লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু, সাধারণ সম্পাদক আসম কামরুল ইসলাম, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাওলানা ফজলুল হক খান সাহেদ প্রমুখ।
এর আগে মঙ্গলবার বাংলা একাডেমি থেকে রওশন আরা বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখানে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার পশ্চিম মণিপুরের বাসায়। এশার নামাজের পর সেখানকার বায়তুল আমান জামে মসজিদে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরদেহবাহী গাড়ি ঢাকা থেকে সাইরেন বাজিয়ে রাত ৩টায় পৌঁছায় কুলাউড়াস্থ উছলাপাড়া গ্রামে তার নিজ বাড়িতে। এসময় আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে চারদিকের পরিবেশ।
জীবদ্দশায় তিনি বলতেন, ‘ভাষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আমি আমার জীবনে যা কিছু করতে পেরেছি তার জন্য মায়ের অবদানই বেশি। যে যুগে আমি পড়াশোনা করেছি, তা যদি আমার মা না দেখতেন তাহলে হতো না।
এখন থেকে কেউ আর এই কথা বলবেন না। জাতি হারালো আরেক ভাষা সেনানীকে। রওশন আরা বাচ্চুর স্থান পূরণ হওয়ার নয় বলে জানিয়েছেন দেশের অনেক খ্যাতিমান ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। শোকে আচ্ছন্ন তার নিজ জন্মভূমি কুলাউড়া।
মূলত বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছিল রওশন আরা বাচ্চুর। পাশাপাশি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। গত রোববার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেদিন ইমার্জেন্সিতে তিন ঘণ্টা রেখে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা খাতুন এ তথ্য দেন। রওশন আরা বাচ্চুর চার মেয়ে। স্বামী শামসুদ্দীন মোহাম্মদ আবদুল তৈমুর মারা গেছেন ২০১৭ সালে।
শ্রদ্ধানুষ্ঠানে রওশন আরা বাচ্চুর ছোট মেয়ে তাহমিদা খাতুন বলেন, আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে ছিলো তার নিজ জন্মস্থানে শায়িত হবেন। আমরা সেই আশা পূর্ণ করেছি। আমার মায়ের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে চাই। এটি হলেই আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবেন।
পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক আহমদ বলেন, কুলাউড়ায় অনেক গুণী ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতি সন্তান। তাদের আন্দোলনের ফসল হলো আমাদের এ প্রাণের বাংলাদেশ।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাজিয়া শিরিন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে বলেন, রওশন আরা বাচ্চুর স্মৃতি রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নিশ্চয়ই কাজ করবো। ৫২ সালে তিনি ভাষাসংগ্রামী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু অত্যন্ত সাহসী নারী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রশ্নে তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। আমি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার উছলাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এ এম আশ্রাফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। ১৯৫৩ সালে অনার্স পাস করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রগ্রেসিভ ফ্রন্ট’-এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইমেন স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। রওশন আরা বাচ্চু সর্বশেষ বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নেন ২০০২ সালে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৯
এসএইচ