সাভার (ঢাকা): শিলা বেগম, রানা প্লাজার ছয় তলার ইথারটেক্স লিমিটেড কারখানায় সুইং সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৩ সালের আজকের এ দিনে রানা প্লাজা ধসের সময় চাপা পড়েন।
সোমবার (২৩ এপ্রিল) রানা প্লাজার ১০ বছর পূর্তিতে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিহত শ্রমিকদের স্মরণ ও বিচারের দাবিতে আহত শ্রমিক ও নিহতের স্বজনদের সঙ্গে এসেছেন তিনি।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার নানা সংকটসহ শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে ঈদ না করতে পারার আক্ষেপের কথা বলেন তিনি৷ জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া এ মানুষটির পরিবারে ঈদ আনন্দ বলতে কিছু নেই।
তিনি বলেন, আমাদের জীবনে ঈদ বলতে কিছু নেই। রানা প্লাজার আমরা যারা আহত শ্রমিক তারা তো সে ১৩ সালেই মারা গেছি। আমরা আজও পর্যন্ত মরা লাশের মতো বেঁচে আছি৷ এটিই কি আমাদের জীবন, আর এটিই কি আমাদের ঈদ আর কোরবানি?। এ ১০ বছরে প্রায় ২০টি ঈদ গেছে কিন্তু, এ ঈদগুলোতে ঘরে বসে সন্তান নিয়ে একটুকু সেমাই ও ভালো খাবার খেতে পারিনি৷
শিলা বলেন, আমি রানা প্লাজার ছয়তলায় কাজ করতাম ইথারটেক্স লিমিটেডে৷ আমি সুইং সিনিয়র অপারেটর হিসেবে কাজ করতাম। এখন আমার পেটে টিউমার, ডায়াবেটিস। ডাক্তার বলছে, যেকোন সময় টিউমার ফেটে যেতে পারে৷ যদি ফেটে যায়, তাহলে ক্যান্সার হয়ে যাবে। আমার বাঁচার উপায় থাকবে না। এজন্য অনশন করছি, এর চেয়ে আল্লাহ নিয়ে যাক। রানা প্লাজা যাদের নিয়ে গেছে, তারা বেঁচে গেছে। কিন্তু আমরা আছি কষ্টে। আমরা বাঁচতে চাই। আমার হাত অবশ। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। পেটের ওপর বিম পড়ে নাড়ি ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছিল গোপনাঙ্গ দিয়ে। প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে প্রস্রাব-পায়খানা করতে হয়। আমার বাড়ি বরিশালে। একটা বাচ্চা। তাকে মানুষের কাছে চেয়ে চেয়ে পড়াশোনা করাচ্ছি। কিছু দিন আগেও মসজিদে মাইকিং করে সাহায্য তুলেছি। আমার বাচ্চাটা ফাইভ, এইট, এসএসসি, ইন্টারে ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু তাকে আমি অনার্সে পড়াতে পারছি না। তাকে বোনের বাড়িতে রাখছি। আর আমি ভিক্ষা করে চলি।
শুধু শিলা বেগমই নয়। তার মতো নিলুফা ইয়াসমিন, মাহমুদুর হাসান হৃদয়, এমদাদুল ইসলাম, নিলুফা বেগম, মাসুদা, বুলবুলী ও মো. আলাউদ্দিনের মতো শ্রমিকদের জীবন চলে এখন দুর্বিষহ অবস্থায়।
নিলুফা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমি মনে করি সরকার আমাদের চার দফা মেনে নেবে। আমাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। ১৮-৬০ বছরে চাকরীজীবনের যে ক্ষতিপূরণ আছে৷ সেটি দেবে। দিলে সন্তানাদি নিয়ে দুই বেলা ডালভাত খেতে পারি। সন্তানদের একটু লেখা পড়া করাতে পারি। ফ্যান্টম আ্যাপারেলসের সুইং অপারেটর ছিলাম।
তিনি বলেন, ২০০৭ এ জয়েন করি। ২০১৩ তে ওই ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আমার পা হারিয়েছি। আমি প্রতিটি মেডিকেলে ঘুরছি। এখন আমার পায়ের একটা অপারেশন প্রয়োজন। ৪-৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু টাকা নেই। আমি ছোট একটা পানের দোকান করি স্ট্যান্ডে। তাও পুলিশের হয়রানি হতে হয়। পুলিশ বাক্স উঠায় নিয়ে যায়। পুলিশ লাঠিপেটা করে। দোকান করতে পারি না। একমাস দোকান খুলতে পারিনি। ৪ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছি। দুই মাসের ঘর ভাড়া জমে গেছে। স্বামী নেই, মা নেই। পরিবার অসহায়। আমাদের শরীরেও হাড্ডি ছাড়া কিছু নেই।
তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজার ধস ১০ বছর হয়েছে। কিন্তু এ ১০ বছরে ধীরে ধীরে আমরা আরও অনেক কিছু হারিয়েছি। আজ ১০ বছর আমরা রানা প্লাজার সামনে আসি। আমাদের যদি ঈদ থাকতো আমরা রানা প্লাজার সামনে আসতাম না। সবার মতো পরিবার নিয়ে ঈদ করতে পারতাম। আজ এসেছি যদি প্রধানমন্ত্রী আমাদের চোখের পানির যেন মূল্য দেয়। আমাদের দিকে একটু তাকায়৷
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বাংলানিউজকে বলেন, রানা প্লাজার আহত ও নিহত শ্রমিকের স্বজনরা তাদের ক্ষতিপূরণ পায়নি৷ এছাড়া রানার দীর্ঘ ১০ বছরের বিচার হয়নি৷ এ ঘটনায় গার্মেন্টস মালিক দায় এড়াতে পারে না। তাদের বিচারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আহত ও নিহত শ্রমিকদের ও তাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সে অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনীয় সহয়তা করততে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০২৩
এসএফ/জেএইচ