ঢাকা: রেলের মোট দুর্ঘটনার শতকরা ৬৩ ভাগ লাইনচ্যুতি এবং ১৭ ভাগ লেভেল ক্রসিংজনিত। এসব দুর্ঘটনা বাস্তবে দুর্ঘটনা নয়।
বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে পবা কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ‘রেল দুর্ঘটনা: কারণ ও করণীয়’ শীর্ষক পর্যালোচনাসহ প্রতিবেদন প্রকাশে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, রেলপথের প্রায় সবই অরক্ষিত। প্রতিনিয়তঃ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। ট্রেন দুর্ঘটনার ধরন প্রধানতঃ লাইনচ্যুতি, লেভেলক্রসিং, ইঞ্জিন বিকল, সিগনাল অমান্য করা। ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতির ফলে একদিকে হতাহতের ঘটনা ঘটছে, অপরদিকে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, রেলপথ পাহারা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়েম্যান নেই এবং যারা আছেন তারাও নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। এছাড়া জনবলের অভাব, রেললাইন নিয়মিত মেরামত না করা, ইঞ্জিন ও বগি যথাযথভাবে মেরামত না করা, মেরামত কারখানায় দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং রেল কর্মকর্তাদের গাফিলতি ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণ।
এতে বলা হয়, একটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল যেখানে বিশ বছর এবং বগির আয়ুষ্কাল ত্রিশ বছর সেখানে ৫০ বছরের পুরানো ইঞ্জিনও চলছে। ৬৫ শতাংশ ইঞ্জিন এবং ৪৫ বগির আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত। রেলের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে মোট ২ হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪১৩টির অনুমোদন আছে, ১ হাজার ১২৮টির অনুমোদন নেই এবং মাত্র ৩০০টিতে প্রহরী রয়েছে। লেভেলক্রসিংয়ে তিন বছরে ৮৭৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থেকেছে। ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ এই দুর্ঘটনাও।
বিভিন্ন জটিলতায় ২২ বছর ধরে রেলওয়েতে দরকারি জনবল নিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে- উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন পদ থেকে কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টসম্যান, পোর্টার, গেটকিপার, বুকিং ক্লার্ক ও সিগনাল কর্মকর্তা ও কর্মীর অভাবে শতাধিক রেলস্টেশন বন্ধ।
রেলের উন্নয়নে বর্তমান সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও রেল পরিচালনায় ও ট্রেন দুর্ঘটনারোধে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো দৃশ্যমান সফলতা চোখে পড়ছে না বলেও মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও জানানো হয়, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত বড় দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে পবা জানতে পারে, এ সময়ে মোট ১৩৩টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এসব দুর্ঘটনার ধরন- লাইনচ্যুতি ৮৪টি (যা মোট দুর্ঘটনার ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ), রেল-রোড ক্রসিংজনিত ২৩টি (যা মোট দুর্ঘটনার ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ), পাটিং বা বিভক্তিজনিত ৬টি (যা মোট দুর্ঘটনার ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ), সিগনাল অমান্য ৫টি (যা মোট দুর্ঘটনার ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ) এবং অন্যান্য ১৫টি (যা মোট দুর্ঘটনার ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ)। এসব দুর্ঘটনায় ৪৪ জনের প্রাণহানি হয় এবং ১০৪ জন আহত হন। র্ঘটনায় রেলের ক্ষয়ক্ষতি হয় ১ কোটি ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৯ টাকা।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এম সফিউল্লাহ, পবার সহ-সম্পাদক মো. সেলিম, মো. নজরুল ইসলাম, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’র প্রকল্প কর্মকর্তা মো আতিকুর রহমান, মো. আকবর প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে পবার পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশও করা হয়। এগুলো হলো- আসন্ন কোরবানি ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে রেললাইন সার্বক্ষণিক মনিটর করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, যাত্রার আগে লোকোমটিভ ও যাত্রী কোচ ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, সিগনাল কার্যকর রাখা ও তা মেনে ট্রেন পরিচালনা করা, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন না চালানো, সাবধানতার সঙ্গে ট্রেন চালানো যেন হঠাৎ ব্রেক কষতে না হয়, লেভেলক্রসিংয়ে সাময়িকভাবে স্থানীয়দের দৈনিকভিত্তিক প্রহরী নিয়োগ দেওয়া; রেললাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, রেলওয়ের লোকবল বৃদ্ধি করা, রেলওয়ের লোকোমটিভ, যাত্রী কোচ ও মালবাহী ওয়াগন বৃদ্ধি করা, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে এবং রেলের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে কারখানাগুলোকে কার্যকর করা; ঝুঁকিপূর্ণ রেল সেতু দ্রুত সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করা, লেভেলক্রসিংয়ে গেট বসানো ও প্রহরী নিয়োগ দেওয়া; ট্রেনচালকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্তদের মধ্য হতে যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া; অতি দ্রুত রেল দুর্ঘটনার চলমান হার কমাতে বা বন্ধ করতে রেল কর্তৃপক্ষকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া এবং রেল ও নৌ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫
এফবি/এইচএ/